ইসলামে নারী শিক্ষার অবস্থান ও উদ্দেশ্যঃ Iftekhar Sifat
(লেখাটা একটু বড় হয়ে গেছে, ধৈর্যসহকারে পড়লে ফায়দা হবে আশা করি)
ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কে শিক্ষা অর্জনের নির্দেশ দেয় এবং উৎসাহ প্রদান করে। কুরআন-হাদিসে এমন কোনো উক্তি নেই যা নারীর শিক্ষা গ্রহণকে নিষিদ্ধ করে কিংবা নিরুৎসাহিত করে। ইসলামের ইতিহাসে অনেক আলিমা, মুহাদ্দিসা, ফকিহা ও খ্যাতনামা নারীদের দৃষ্টান্ত আছে। যেই সাতজন মহান ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের প্রজ্ঞা গণমানুষের কাছে পৌঁছেছে, তাদের একজন হলেন উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা। এমনকি ইসলামি ইতিহাসে নারীরা ফতোয়া প্রদানের খেদমতও আঞ্জাম দিয়েছেন।
ইসলামে নারীর শিক্ষা কোনো গৌণ বিষয় নয়; বরং এটি একটি আবশ্যকীয় বিষয়। এজন্য কেউ নারীর শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করতে পারে না। এমনকি কোনো নারী যদি উচ্চশিক্ষাও অর্জন করতে চায়, তবে তাকে বাধা দেওয়া বৈধ হবে না। তবে সেই শিক্ষা, তার পরিবেশ ও উদ্দেশ্য অবশ্যই নারীর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্বের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া যাবে না। ইসলামি শরিয়াহর নীতিমালা ও চাহিদার পরিপন্থি হওয়া যাবে না।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ত্রুটি এটাই যে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কাউকেই এই শিক্ষা তাদের প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে সচেতন করে না। তাদের আদর্শ পিতামাতা, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা এখানে নেই।
বিশেষ করে সমাজে নারীশিক্ষার যেই আষ্ফালন, তার পুরো প্রজেক্টই পশ্চিমাবান্ধব। এই শিক্ষা প্রজেক্টের অন্যতম এজেন্ডা হলো, নারীকে কেবল একজন উৎপাদক যন্ত্র হিসেবে আমদানি করা। প্রচলিত নারীশিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, নারীকে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত করা, নারীকে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সমান হওয়ার এক অপ্রাকৃতিক ও ঘৃণ্য প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেওয়া।
উপনিবেশ আমলে যখন মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন শায়খ মুস্তফা আস সবারি রহিমাহুল্লাহ কওলি ফিল মারআহ ওয়া মুকারানাতুহু বি আকওয়ালি মুকাল্লিদাতিল গারবি নামক গ্রন্থ লেখেন। এই বইয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি নারীদের শিক্ষার ভিত্তি হওয়া উচিত তাদের প্রধান ও স্বভাবজাত দায়িত্ব পালন।
অর্থাৎ পরিবার পরিচালনা, সন্তান প্রতিপালন ও তাদের চরিত্র গঠন। এবং তাদের শিক্ষার ভিত্তি হওয়া উচিত পারিবারিক ব্যবস্থাপনা, সুস্থতা ও অর্থনীতির ওপর। সব কাজে ও সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের সমান হওয়ার জন্য তাদের শিক্ষা কর্মসূচি হওয়া উচিত নয়। কারণ এটা সম্ভবও না, কল্যাণকরও না। আর নারী-পুরুষের সমতার যেই দাবি, এটা কখনোই সম্ভব নয়। একজন পুরুষের জন্য যেসব বিষয় উপযুক্ত, তার সবগুলো একজন নারীর জন্য উপযুক্ত হবে না। একই কথা বিপরীত ক্ষেত্রেও।
এজন্য নারী-পুরুষের শিক্ষা কর্মসূচি এক হওয়া মারাত্মক ক্ষতিকর। শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো, সমাজের সদস্যদের স্ব স্ব দায়িত্বে দায়িত্ববান করে তোলা। দীনের বুনিয়াদি শিক্ষার পর স্ত্রী ও মা হিসেবে একজন নারীর শিক্ষায় প্রথম অগ্রাধিকার পাবে এই সংক্রান্ত শিক্ষা অর্জন করা। এজন্য শায়খ মুস্তফা আস সিবায়ি রহিমাহুল্লাহ মনে করতেন, বিশেষভাবে পরিবার পরিচালনা-সংক্রান্ত বিদ্যা মেয়েদের পাঠ্যসূচিতে বেশি পরিমাণ থাকা উচিত। যাতে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে সফলতা অর্জন সহজ হয়।
পাশাপাশি মেধা অনুপাতে এবং দীন, উম্মাহ ও সমাজের প্রয়োজনে তার ফিতরাতের সাথে সামঞ্জশ্যপূর্ণ বিভিন্ন শাস্ত্রেও একজন নারী ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে পারে। নারীর শিক্ষা কর্মসূচি এমন হতে হবে, যা তাকে আদর্শ স্ত্রী ও মা হিসেবে গড়ে তুলবে। তাকে পুরুষের সমকক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার বাসনায় উন্মাদ করবে না।
তাকে পরিবার থেকে বিমুখ করে বহির্মুখী করে তুলবে না। তাকে এমন কোনো পেশা কিংবা পরিবেশে ঠেলে দেবে না, যেখানে তার নারীত্ব ও মর্যাদা মারাত্মকভাবে শোষিত হয়, কিন্তু সেটা সে অনুভবও করতে পারে না। তাকে মাতৃত্বের পরিচয় ছাপিয়ে কেবলই একটা উৎপাদক যন্ত্র হওয়ার লিপ্সায় অন্ধ করে তুলবে না।
ইসলামে নারীশিক্ষা কর্মসূচির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এই কর্মসূচি প্রথমে তাকে আল্লাহর আবদিয়্যাত বাস্তবায়নের চেতনায় উজ্জীবিত করবে। তারপর তাকে একজন আদর্শ পরিবার পরিচালক ও প্রজন্ম তৈরির কারিগর হিসেবে গড়ে তুলবে। সবশেষে তার ফিতরাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে সেবা দেওয়ার জন্য তাকে যোগ্য করে তুলবে।( আধুনিক প্রাচ্যবাদের কবলে মুসলিম নারী সমাজ, ১৪০-১৪২। বোনদের জন্য বইটি পড়া জরুরী মনে করি।)
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও বোনদের জন্য কিছু পয়েন্টঃ
১) ইসলামের বিধান বজায় রেখে নারীশিক্ষার চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কখনোই নারীদের প্রয়োজনীয় উচ্চশিক্ষা থেকে নিবৃত্ত করতে চাইনা আমরা চাই উচ্চশিক্ষার ইসলাম সম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে। তবে যতক্ষণ সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত না হয় ততক্ষণ এই উচ্চশিক্ষা আবশ্যক না।
উপরে উল্লিখিত সকল আলোচনা রুখসতের অন্তর্ভুক্ত। নতুবা আযীমত বা তাক্বওয়ার দাবী হচ্ছে অনৈসলামিক সিস্টেমের সাথে সংযুক্তই না হওয়া।
আমরা বিশ্বাস করি জাগতিক শিক্ষার চেয়ে ইসলামের মূল্য অনেকবেশি। আমাদের জীবনের সবকিছুর চেয়ে আল্লাহর সন্তষ্টি অনেকগুন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
২) পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক দায়িত্ব সাধারণত পুরুষদের। এজন্য তাদের ক্ষেত্রে শিক্ষা লাভের পাশাপাশি সার্টিফিকেট লাভ মূখ্য বিষয়।কারণ সার্টিফিকেট ছাড়া জব কিংবা কোন প্রকার কর্মসংস্থানে আসা প্রায় অসম্ভব৷ কিন্তু বোনদের উপর এই দায়বদ্ধতা নেই। ( নির্দিষ্ট পরিস্থিতির শিকার হওয়া ছাড়া) বোনদের ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট মূখ্য না হয়ে শিক্ষা লাভই মূখ্য হওয়া উচিত।
ফলে সম্ভব হলে ইসলামবান্ধব কিংবা ব্যক্তিগত বা অনলাইন শিক্ষার ব্যবস্থাকেই বোনদের প্রায়োরিটি দেয়া উচিত। এই ক্ষেত্রে ফ্রি মিক্সিং তো পুরুষদের জন্যও নিষিদ্ধ, তাদের জন্যও তো ইউনিভার্সিটিগুলোতে যাওয়া হারাম হওয়ার কথা, এসব যুক্তি দেখানো সম্পূর্ণ ভুল। কারণ বিষয়টাতে তার ও পুরুষের অবস্থান ও দায়বদ্ধতা সমান না।
৩) বাবা মা অথবা গুরুজনরা যদি কখনো সরাসরি অনৈসলামিক কোন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে তাহলে ভদ্রভাবে বিনয়ের সাথে তা এড়িয়ে যেতে হবে। ইসলাম যেমনিভাবে কোন অবস্থাতেই গুরুজনের অসম্মানকে সমর্থন করেনা তেমনিভাবে কোন অবস্থাতেই কারো ইসলাম বিরোধী নির্দেশ মেনে নেয়াকে অনুমোদন করেনা।
রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবেনা।
(সৃষ্টির) আনুগত্য শুধুমাত্র (শরীয়তের দৃষ্টিতে) বৈধ ও গ্রহনযোগ্য বিষয়ে করা যাবে।
আবার এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া, কিংবা তাদেরকে উত্তেজিত করে নিজের দ্বীন পালনকে কঠিন করে ফেলা মোটেও উচিত হবে। এতে করে অনেক দ্বীনদার বোনকে দ্বীনহীন হতে হয় কিংবা আরো সংকীর্ণ ও দুর্বিষহ অবস্থায় পতিত হতে হয়।
৪) যদি কোন নারী পরিবারের চাপে অনৈসলামিক পরিবেশে পড়াশোনা করতে একান্তই বাধ্য হন এবং আর্থসামাজিক সমস্যা সহ অন্যান্য কারনে পরিবারের বিপরীতে সেখান থেকে সরে অসা তার জন্য আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব হয়ে পড়ে, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন তাহলে তিনি মা'যুর। অক্ষম। আমরা আশা করি আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করবেন।
৫)তারপরেও সেকুলার প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে হলে জেনারেল শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে মেয়েরা অবশ্যই অবশ্যই গার্লস স্কুল বা উইমেন্স কলেজ বেছে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। পর্দাহীন সহশিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে কোনক্রমেই ভর্তি হবেনা। বাবা মায়েরা এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে মেয়েদের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে অথবা যে প্রতিষ্ঠানে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের স্বতন্ত্র ব্যাবস্থা আছে সেখানে ভর্তি হবে। এমন কোন ব্যবস্থা না হলে এবং পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে ভর্তি হওয়া খুব জরুরী হলে অবশ্যই এমন ইউনিভার্সিটি বেছে নেবে যেখানে সম্মিলিত শিক্ষা ব্যাবস্থা সত্ত্বেও তার পর্দা-নিকাব করার পূর্ণ অধিকার থাকবে।
(মুসলমান ছাত্র ছাত্রীরা শুধু সেসব বিষয়েই ভর্তি হবে যেগুলো সত্যিকারার্থে মানবজীবনের জন্য জরুরী।এছাড়া অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় বিষয় যেমন, অভিনয়, চারুকলা(মূর্তি, ভাস্কর্য, আঁকাআকি, নৃত্য) ইত্যাদি সেক্টরে পড়াশুনা বৈধ না।)