বাংলা ইসলামিক নতুন গল্প "প্রিয় শিরিন, লেখনীতেঃ নাহিদা সানজিদ" : বাংলা ইসলামিক গল্প ২০২৪

 - "শিরিন? শিরিন? এই শিরিন?"

ফিসফিসে কন্ঠস্বর জুম্মানের। শিরিনের আধঘুম ছুটে গেলো। বুকের ঢিপঢিপ শব্দটার গতি যেন বাড়লো খানিক। জুম্মান অবশেষে এসেছে তবে! ঘুমন্ত শিশুপুত্র খালিদকে বুকে চেপে শব্দহীন পায়ে দরজার ছিটকিনিটা খুললো শিরিন। ওমনি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো জুম্মান। কী ভীষণ তাড়াহুড়ো ছেলেটার! দ্রুত ছিটকিনিটা আটকে সস্তি মিললো তার। ঘুমন্ত খালিদকে কোলে নিতে গিয়ে পুরুষালি শক্ত হাতটা যেন নমনীয় হয়ে গেলো আকস্মাৎ। ব্যথা পাবে না তো ছেলেটা? ছেলের কপালে,গালে চুমু খেলো পরপর। সন্তানের গায়ের গড়নে কল্পনা করে এক মহান বীরের প্রতিচ্ছবি৷ শিরিন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে৷

- "আসসালামু আলাইকুম!"
মৃদুস্বরে সালাম দেয় জুম্মান। শিরিন খানিকটা কেঁপে উঠলো। অবিকল ওর মতো ফিসফিস করে সালামের জবাব দিলো সে৷ জুম্মান হাসে। শিরিন চোখ সরিয়ে ফেলে, লোকটা যে ভীষন সুন্দর!

খালিদের জন্ম যেদিন হয়, সেদিন ওদের বেড়া-মাটির ঘরখানিতে একটুকরো আস্ত জ্যোৎস্না আসে। কী আনন্দ জুম্মানের! সে ভেবেই পাচ্ছিলো না নাম কী রাখবে। আচ্ছা আলী রাখলে কেমন হয়? আলী (রাঃ) মতো বুদ্ধিমান বীর হবে! না না অতো বড় স্বপ্ন দেখতে নেই, খালিদ বিন ওয়ালিদ? শিরিনের হাসির শব্দে ভ্রু কুঁচকেছিলো সে। এটা হাসির কথা নাকি? কত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার, আর এই মেয়েটা হাসছে। বিড়বিড় করে বলেছিলো, "কেন যে এমন পাগলকে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম, মাবুদ!"

এক দফা কথা ছোঁড়াছুঁড়ি শেষে ছেলের নাম রাখা হলো খালিদ, খালিদ বিন জুম্মান। সেদিন শেষরাতে তাহাজ্জুদ শেষে জুম্মান শিরিনকে ডেকে বলেছিলো, "দেখো শিরিন, আমার ছেলে সত্যি খালিদ বিন ওয়ালিদের মতোই হবে, তুমি কখনো ওকে ভয় পেতে শিখাবা না। আমার আমানত থাকবে তোমার কাছে।" কি কান্নাটাই না করেছিলো সে।

নতুন ইসলামিক গল্প ২০২৩



শিরিন সবসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে দুআ করে, "লোকটা ভালো থাকুক। ওর জীবনের সুখটুকুও এ মানুষটার নামে হোক। তার জীবনের ভালোবাসার ভাগ-বাঁটোয়ারার একটু অংশ শিরিনের নামে করে দিক। ঐ জান্নাতেই এই ছটফটে তরুনটাই তাঁর সাথী হোক।" এই তো! আর কি চাই?

এসব ভাবতে ভাবতে শিরিন ভাতের হাঁড়িতে আরেকবার উঁকি দেয়। ভাত নেই। যা আছে শুধু একজনেরটাই হবে, কে জানে শিরিনের হয়তো এজন্যই খুদা লাগেনি? মরিচ ভর্তা ছাড়া আর কিছু পেলো না সে৷ ডাল তো সেই কবেই ফুরালো৷ ওপাশ থেকে জুম্মানের চড়াগলা,
" শিরিন, কিছু দাও, ভীষন ক্ষুধা পেয়েছে গো।" শিরিনের আফসোসে চোখে জল জমে যায়। মনে মনে ডাকতে থাকে রিজিকের মালিককে। কী ভেবে একবার উঁকি দেয় মুরগির ঘরটায়। নোংরা মেঝের মাঝখানটায় একখানা ডিম ভেসে আছে অবহেলায়। শিরিনের জমে থাকা জলগুলো আনন্দাশ্রু হয়ে বেয়ে পড়ে কপোল বেয়ে। আহ্! মাঝে মাঝে রব কতোই না তাড়াতাড়ি দুআ কবুল করেন! তবুও অকৃতজ্ঞ আমরা, চরম অকৃতজ্ঞ..

শিরিন ডিমটা এনে ভাজলো লাল লাল করে। থালার একপাশে যত্ন করে তুলে দিলো পাতে। কতদিন পর এলো মানুষটা! একটু মন ভরে খাক, ওখানে কি খায় কে জানে? শিরিন গালে হাত দিয়ে দেখে যায় অপলক। জুম্মান খেতে খেতেই প্রশ্ন ছুড়ে,
- "তুমি খেয়েছো শিরিন?"
শিরিনের বুক কেঁপে ওঠে। মিথ্যে বলবে কীভাবে সে?
আমতা আমতা করে বলে,
- "আমার খিদে পায়নি তো তাই।"
জুম্মানের হাত থেমে যায়। ভাতটাও নেই ঘরে! দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে কপালে, পরক্ষণেই মিলিয়ে যায় কি ভেবে। স্বয়ং আল্লাহ যার অভিভাবক তার কী কপালে ভাঁজ পড়া সাজে? কখ্খনো না..

ভাতের লোকমা তুলে শিরিনের দিকে বাড়ায়। শিরিন নাকচ করতে চায়, কড়া দৃষ্টির কাছে হার মেনে যায় সব টাল-বাহানা।

ফেসবুক ইসলামিক লেখা পোস্ট

______________________________
- "শিরিন? যেতে হবে এখন।"
শিরিন কিছু বলে না, নত মুখে দেখতে থাকে সব। জুম্মান চামড়ার বর্মটা বুকে আটকাতে থাকে, পায়ের কাপড় সরিয়ে পূর্বের আঘাতটা পর্যবেক্ষণ করে একটু। শিরিন বিস্ময়ে মুখে হাত দেয়। জুম্মান লুকিয়ে ফেললো দ্রুত।

- "আপনি আঘাত পেয়েছেন, আগে বলেন নি কেন? আল্লাহ! কতোটা কেটে গেলো!"
শিরিনের কান্নাজড়িত কন্ঠ। জুম্মান তার বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরায়। কপালে চুমু দিয়ে, চোখ মুছিয়ে দেয় যত্নে। এরপর হেসে বলে,
- "এজন্যই বলিনি, শিরু। এভাবে নাককাঁদবে তাই। কই স্বামীকে সাহস দেবে, না কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছো আমাকে।"
শিরিন কিছু বলে না। জুম্মান আবার বলে,
- "যাই এবার?"
শিরিন প্রতিবাদ করে বলে,
- "যাই না আসি বলুন।"

জুম্মান হাসে শুধু কিছু বলে না। বেরিয়ে যেতে গিয়েও কী ভেবে আবার ঢুকে। ছেলেটার মাথায় শেষবারের মতন দীর্ঘ চুমু খায়। ছোট ছোট আঙ্গুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, "আব্বু, তুমি একদিন অনেক বড় হবে, ঘোড়সওয়ার হয়ে ছুটবে দিগবিদিক, আমি হবো তোমার সেনা। তোমার তীর জালিমের বুক বিদীর্ণ করবে,আমি হবো তোমার ঢাল। তোমার তরবারি শত্রুর আতঙ্ক হবে,আমি হবো তোমার সহচর। মনে থাকবে?"
ঘুমন্ত খালিদের ভ্রুজোড়া খানিকটা নেচে ওঠে। জুম্মান কল্পনায় দেখে, সুঠাম, শক্তপোক্ত শরীরের ছেলেটা তার হাতের কুঁচকানো চামড়ায় চুমু খেয়ে বলছে, "মনে থাকবে বাবা, মনে থাকবে...."

জুম্মান মায়া বাড়ায় না। ঘোড়ার লাগাম টেনে জোরগলায় ডাক দেয় তার সহচর বৃদ্ধকে। ঘোড়ায় উঠতে উঠতে বলে,
-"চাচা? ওর যা লাগে খেয়াল রাখবেন।"
এরপর শিরিনের দিকে একপলক তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে বলে,
- "ঘোড়ার ডিমের চেয়ে দুষ্প্রাপ্য হলেও এনে দেবেন কিন্তু।"
মুহূর্তের মাঝেই টগবগে শব্দে আলোড়িত হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেলো সে। পেছনে ফেলে গেলো দুনিয়াবি সকল মায়ার বন্ধন, ভালোবাসা আর ঘরভর্তি সৃষ্টিকর্তার প্রতি মহব্বতের আলোকছটা। শিরিনের চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে অশ্রু। মৃদু শব্দে দরজা লাগিয়ে বুক চেপে বসে থাকে সে। বুকের ভেতর অবিরাম চলতে থাকা ঢিপঢিপ ধ্বনি যেন প্রশ্ন করতে থাকে, "কবে আসবেন আবার.. কবে আসবেন.."

_______________________________
নিশিরাতের নিস্তব্ধ এ রজনীতে শিরিন ঘরের কোণে বসে থাকে নির্বিকার। যাওয়ার দুদিন পরই দূত এসে ছিলো সকালবেলা। তাকে দুটো জিনিস দিয়ে গেছে। পুরোনো মলাটের একটি বই। যেখানে মোটা অক্ষরে বড় বড় করে লেখা "খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)"। এটা দেয়ার কারণ সন্তানের তারবিয়াতে যেন সহায়ক হয়। আরেকটা হলদে কাগজে দোয়াত-কালির একখানা চিঠি। শিরিন চিঠিটা খুলে কৌতুহল নিয়ে। পড়তে পড়তে লেপ্টে যেতে থাকে কালি,শিরিনের আঁখিজলে..

প্রিয় শিরিন,
প্রথমেই আমার জীবনের ভালোবাসার ভাগ-বাঁটোয়ারা তোমার অংশটুকু নাও, যা হয়ত তুমি সবসময় চাও। আমি তোমাকে ভালোবাসি,আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। তোমাকে আমার কখনোই বলা হয়ে ওঠেনি, আমি তোমায় ভীষন ভালোবাসি। তুমিও কখনো বলোনি। তুমি হয়ত জানো না, পুরুষেরা অনুভূতি প্রকাশে ভীষন আনাড়ি।

আমার প্রতি কী তোমার অনেক অভিমান,শিরিন? হয়ত! অন্যদের মতো যে, আমাদের কখনো মধুচন্দ্রিমা উপভোগ করা হয়নি। হয়নি কখনো জ্যোৎস্না-বিলাস বা গোধূলীলগ্ন উদযাপন, অনুভব করা হয়নি হেমন্তের শিশির ভেজা প্রভাতটুকুও। এমন কি বিয়ের প্রথম রাতটুকুতেও তোমায় আমার সঙ্গ দেয়া হয়নি। তুমি নাকি ভীষন কেঁদেছিলে?

কী করব আমি,বলো? তোমার স্বামীর জন্ম যে বউয়ের অভিমান ভাঙাতে হয়নি..

আমাদের বিয়ের দিনের কথা তোমার মনে আছে,শিরিন? জুমাবারে যেদিন তোমার বাবা যখন আমায় বগলদাবা করে নিয়ে চারহাত এক করে দিলেন? আমার ভীষণ রাগ হয়েছিলো, জানো? অনিশ্চয়তায় ঘেরা জীবনে আমি কাউকে জড়াতে চাইনি। তোমার বাবা আমার বিশ্বস্ত একজন আপন কেউ ছিলেন। তিনি জানতেন, আমি নাম লিখিয়েছি সৈনিকদের খাতায়, শহীদ হবার আকাঙ্খায়..

আমার জন্মের আগেই আমার বাবা মারা যান। আমার বাবাকে আমি কখনো দেখিনি,না পেয়েছি তার দরদমাখা স্পর্শটুকু। ছোটবেলা থেকেই আমার মায়ের অশ্রু-লুকানো আঁচলতলে আমার বড় হওয়া।
জানো শিরিন?
আমি এ পৃথিবীতে দুজন নারীকেই ভালোবাসি, একজন আমার নিজের মা, আরেকজন আমার নিজ সন্তানের মা..
শিরিন? তুমি কী জানো? তুমি আমার খেলার সাথী ছিলে। আমার জন্য নাকি তোমার ভীষণ মায়া হতো। তুমি ধনী বাবার আদুরে সন্তান ছিলে যে..
এই দেখো,আমায় এত মায়া কর যে আমার খড়কুটোর ঘরখানিতে আজীবনের জন্য রয়ে গেলে।
আমি যখন সৈন্যদলে নাম লেখাই তখন আমার ত্রিভূবনে রক্তের না কোনো টান ছিলো,না সম্পর্ক। মা দ্বায়িত্ব অব্যাহতি দিয়ে চলে গেলেন সেই কবেই। তোমার বাবা সব জেনেও তোমায় ঝুলিয়ে দিলেন আমার গলায়। কী বিরক্তটাই না হয়েছিলাম সেদিন! তারপর? তারপর একদিন এসে তোমায় গম্ভীর কন্ঠে বলে দিলাম আমার স্বপ্নের কথা। তুমি নিশ্চুপে শুনে বলেছিলে, "আমি আপনার পাশে আছি।"

আমি অবাক ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি সত্যি পাশে ছিলে। যাযাবর জীবনের এই ছেলেটার সাথে একদম মিশে গিয়েছিলে, মূল্যবান কাপড় ছেড়ে বছর ধরে মানিয়ে নিয়েছিলে কয়েক স্বর্নমুদ্রার তাঁতের শাড়িতে..

শিরিন?
আমি তোমায় ভালোবাসি এটা যেমন সত্যি, তার চেয়ে বড় সত্যি আমার রব,যাকে ভালোবাসি তার'চে হাজারগুন। আমি আমার জীবন কেবল তাঁর জন্যই উৎসর্গ করার স্বপ্নে বিভোর। তুমি দুআ করবে শিরিন যেন শহীদের স্ত্রী হতে পারো..

আজকের পর থেকে নিয়ম করে কেউ জ্বালাবে না আর তোমায়। কারো অপেক্ষায় সন্ধ্যাবাতিটাও জ্বালিয়ে রাখবে না আর। রাত জেগে চোখের নিচটায় পড়বে না কালো আস্তরণটুকুও। না খেয়ে ভাত জমিয়েও রাখতে হবে না আর। কিন্তু আমার চোখ দুটো ভীষন জ্বলছে কেন বলো তো!

শিরিন?
আমি আজ আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটি কথা বলবো। আমার মৃত্যুর সংবাদ পাবার পর তুৃমি অবশ্যই বিয়ে করবে আবার। তোমার গর্ভে আবু বকর, উমর, উসমান, আলী (রাঃ) দের মতো বীরেদের জন্ম হবে। আমার ভীষন হিংসে হচ্ছে জানো,কারণ তাদের বাবাটা বোধ হয় আমি হব না। আমি দুঃখ পাব না, জান্নাতে নাকি হিংসা বলতে কিছু থাকে না।
জান্নাতে যখন আমার চাওয়া সম্পর্কে জানতে চাওয়া হবে, আমি না হয় তোমাকেই চেয়ে নেব। তুমিও আর বিচ্ছেদ ব্যথায় মুখ লুকিয়ে কাঁদবে না বারবার।

আর লিখতে পারছি না, আমাদের সংগ্রাম খুব কাছেই। বিজয়ের পতাকাটা মুসলিমরাই ওড়াবে, দেখো তুমি৷ কাল ভোরে তোমার-আমার শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি অনেক দূর, হয়ত ফিরব না। এটা হয়ত আমাদের দুনিয়াবি শেষকথন। তুমি আর খালিদকে আল্লাহর নিকট সৌপর্দ করলাম। ফি আমানিল্লাহ্..
ইতি,
তোমার 'আপনি'
-----------------------------------------------------------------
প্রিয় শিরিন,
লেখনীতেঃ নাহিদা সানজিদ
বিঃদ্রঃ গল্পে লেখা চিঠিটা তুর্কি শহীদ আনোয়ার পাশার তার স্ত্রীকে দেয়া চিঠির সাথে মিলে যায় কিছুটা,ব্যাপারটা কাকতালীয় ছিলো আমার জন্য। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
#জাগরণএক্সক্লুসিভ

বিশেষ ঘোষণাঃ
সাইট থেকে কোন লেখা রিমুভ করতে কিংবা আপনার কোন লেখা পোস্ট করতে আমাদের পেজে একটি এসএমএস দিন।
Next Post Previous Post