নারীবাদের ধর্মবিদ্বেষের ইতিহাস পুরনো। পাঠক হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন–এখানে নারীবাদের কোন পর্যায় নিয়ে কথা বলা হচ্ছে? হয়তো সমস্যা নারীবাদে না; বরং নারীবাদের নির্দিষ্ট কোনো সংস্করণে?
.
আসলে সমস্যা নারীবাদেই। সমস্যা নারীবাদের মূল আদর্শেই। একটা উদাহরণ দিই। বর্ণবাদ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। মানুষের গায়ের রং কিংবা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ ইসলাম কোনোভাবেই মেনে নেয় না। কিন্তু পৃথিবীর সব বর্ণবাদী দলের আদর্শ কিন্তু একরকম না। ক্যু ক্লাক্স ক্ল্যান, নিও নাৎসি, অলট-রাইট–সবার আদর্শ হুবহু এক না। তাদের চিন্তার সূক্ষ্ম তারতম্য আছে, ধরন এবং মাত্রায় আছে নানান পার্থক্য। কিন্তু শেষ বিচারে এই পার্থক্যগুলো তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ না, কারণ সবার মূল আদর্শ এক–বর্ণবাদ।
.
একইভাবে নারীবাদের বিভিন্ন পর্যায় আর সংস্করণগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সবার মূল আদর্শ এক। দয়া করে কেউ আবার এটা ভেবে বসবেন না যে আমি নারীবাদকে বর্ণবাদী বলছি। আমি কেবল উদাহরণ দিচ্ছি।
.
নারীবাদ এমন এক আদর্শ, যার মূলনীতিগুলো মেনে নিলে এবং সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করলে, তা একজন মুসলিমকে ঈমানের সংকট এবং রিদ্দার দিকে নিয়ে যাবে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। কীভাবে প্রথম ধাপ থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে একজন মানুষ পঞ্চম ধাপের দিকে এগিয়ে যায় সেটা বুঝলে পুরো প্রক্রিয়া আমাদের সামনে স্পষ্ট হবে।
.
আর এতেও যদি পাঠক সন্তুষ্ট না হন তাহলে সরাসরি নারীবাদের শেকড়ের দিকে তাকানো যেতে পারে। নারীবাদের সবচেয়ে নামিদামি তাত্ত্বিকদের বলা কথার দিকে তাকালে বাস্তবতা পরিষ্কার হয়ে যায়। গোড়া থেকেই নারীবাদ ছিল একটা ধর্মবিরোধী মতাদর্শ। নারীবাদের প্রতিটা পর্যায়ের রথীমহারথীরা ছিল তীব্রভাবে ধর্মবিদ্বেষী।
.
নারীবাদের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঊনবিংশ শতাব্দীতে, সামাজিক আন্দোলন হিসেবে। এ আন্দোলনের মূল লক্ষ ছিল ভোটাধিকার ও সম্পদের মালিকানাসহ বিভিন্ন আইনি অধিকার। এটাকে বলা হয় নারীবাদের ফার্স্ট ওয়েভ বা প্রথম পর্যায়। তখন থেকেই নারীবাদীরা ধর্মকে নারীর পরাধীনতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে।
.
প্রথমদিককার নারীবাদীরা তাত্ত্বিকরা মনে করতেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল নারীঅধিকার খর্ব করার পেছনে ভূমিকা রাখে না; বরং ধর্মই হলো নারীবিদ্বেষী বিশ্বাস ও আচার-আচরণের মূল উৎস। নারী ভোটাধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেত্রীদের একজন, সুসান বি অ্যানথনি বলেছিল-
.
‘নারীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শত্রু হলো গির্জার বেদি’। [১]
.
সুসান অ্যানথনি নিয়মিত ধর্মের সমালোচনা করত। ঘনিষ্ঠজনদের বক্তব্য অনুযায়ী সে ছিল অজ্ঞেয়বাদী। ধর্মের ব্যাপারে সে বলেছিল–
.
‘একদিকে একের পর ক্ষুধার্ত মুখ পাঠায়, অন্যদিকে সেই মুখে তুলে দেয়ার মতো খাবার দেয় না–তাদের এই ঈশ্বর কতই-না ভয়ংকর এক জীব’! [২]
.
সুসান বি অ্যানথনি আরও বলেছিল,
.
‘মহাবিশ্বের এমন কোনো স্রষ্টার কথা আমি ভাবতে করতে পারি না, আমার নতজানু হওয়া আর স্তুতিবাক্যের ওপর যার সন্তুষ্টি নির্ভর করে’। [৩]
.
ঊনবিংশ শতাব্দীর আরেক উল্লেখযোগ্য নারীবাদী হেলেন এইচ গার্ডনার। নারীর বিরুদ্ধে খ্রিষ্টধর্মের ‘অপরাধ’ আর নিপীড়ন’ নিয়ে অনেকে লেখাজোখা ছিলেন হেলেনের। সে লিখেছিল–
.
‘এই ধর্ম আর কিতাব (বাইবেল) নারীর কাছে দাবি করে সবকিছু। বিনিময়ে দেয় না কিছুই। এরা নারীর সমর্থন আর ভালোবাসা চায়, বিনিময় দেয় অত্যাচার, নিগ্রহ আর অবজ্ঞা …খ্রিষ্টধর্মীয় দেশগুলোতে নারীর বিরুদ্ধে যত অত্যাচার আর নিগ্রহ হয়েছে, সেগুলোর বৈধতা দিয়েছে বাইবেল আর টিকিয়ে রেখেছে গির্জার বেদি’। [৪]
.
গার্ডনারের ঘৃণা শুধু খ্রিষ্টধর্মের প্রতি ছিল না। Men, Women And Gods বইতে সে লিখেছিল–
.
‘ধর্মগুলো যদিও অতিপ্রাকৃত উৎস থেকে আসার কথা বলে, কিন্তু আমি মনে করি এই দাবিগুলোকে যাচাই করা উচিত মানবীয় বুদ্ধির আলোকে। আমাদের সর্বোচ্চ নীতিবোধ যদি ধর্মের কোনো বিধানকে মেনে নিতে অস্বীকার করে তাহলে সেই বিধান বাদ দিতে হবে। কারণ, ধর্মের একমাত্র ভালো জিনিস হলো নৈতিকতা। আর নৈতিকতার সাথে বিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই।
.
নৈতিকতার সম্পর্ক দুনিয়াতে সঠিক কাজ করার সাথে, আর বিশ্বাসের সম্পর্ক পরকালের অজ্ঞাত বিষয় নিয়ে। একটা হলো সময়ের চাহিদা আরেকটা চিরন্তনের স্বপ্ন। নৈতিকতার ভিত্তি হলো সর্বজনীন বিবর্তন। বিশ্বাসের ভিত্তি হলো ‘ওয়াহি’। আর আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ‘ওয়াহি’ এসেছে তার কোনোটাই নারীর পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না।
.
মুসা কিংবা কনফুশিয়াস, মুহাম্মাদ কিংবা পল, ইব্রাহিম কিংবা ব্রিঘাম ইয়াং [৫] এসে আমাদের সামনে দাবি করে তার ধর্মমত ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে। ঈশ্বর এদের কোনো একজনের সাথে বা সবার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে এই ধর্মগুলো দিয়েছে কি না, তার কোনো মূল্য আমাদের কাছে নেই। যদি তাদের ধর্মমত আমাদের নৈতিকতা, সুচিন্তা, উন্নত আদর্শ এবং বিশুদ্ধ জীবনবোধের সাথে খাপ না খায় তাহলে আমাদের ওপর এসব ধর্মের কোনো কর্তৃত্ব নেই।
.
তাদের মধ্যে কে আছে এই পরীক্ষায় পাশ করার মতো? আজ পর্যন্ত যত ‘ওয়াহি’ এসেছে, তার কোনটা ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে দাবি করতে পারে,
.
“আমি তোমাদের সর্বোত্তম বিকাশের সমকক্ষ, আমি আজও তোমাদের সর্বোন্নত চিন্তার পথ দেখাতে সক্ষম, আমার মধ্যে এমন কোন শিক্ষা নেই, যা তোমাদের ন্যায়বিচারের বোধের সাথে সাংঘর্ষিক?”
.
একটাও না’। [৬]
.
নারীবাদের প্রথম পর্যায়ের প্রথম সারির তাত্ত্বিকদের অনেকের লেখায় ধর্মের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ দেখা যায়। এদের মধ্যে ইলিসাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন তো চরম উগ্র এবং উসকানিমূলক The Women’s Bible রচনার পেছনে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল। হাল আমলের কোনো মুসলিম নারীবাদী যদি ‘দা উইমেনস কুরআন’ লেখা শুরু করে তাহলে সেটা অভিনব কিছু হবে না; বরং তা হবে এক শ বছর আগের সেই ফার্স্ট ওয়েভ নারীবাদের অনুকরণমাত্র।
.
মনে রাখবেন নারীবাদের পর্যায়গুলোর মধ্যে প্রথম পর্যায়কে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম উগ্র এবং আপত্তিকর ধরা হয়। এর পরের প্রতি প্রজন্মে নারীবাদের ধর্মবিদ্বেষ আরও বেড়েছে।
.
নারীবাদের দ্বিতীয় পর্যায় বা সেকেন্ড ওয়েভের কথাই ধরুন। বলা হয় নারীবাদের সেকেন্ড ওয়েভের শুরু ফরাসী দার্শনিক সিমন দি ব্যুভয়ার হাত ধরে। ধর্মের প্রতি তার বিরোধিতা সিমন প্রকাশ করেছিল এভাবে–
.
‘পুরুষের বড় সুবিধা হলো পুরুষের লেখা নিয়মগুলোকেই ঈশ্বর বৈধতা দিয়েছে। আর পুরুষ যেহেতু নারীর ওপর কর্তৃত্ব করে তাই সার্বভৌম সত্তাও যে ধর্মমতে পুরুষকেই কর্তৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে, এটা বিশেষ সৌভাগ্যই বলতে হবে। ইহুদী, মোহাম্মাদান, খ্রিষ্টধর্মসহ অন্যান্য সব ধর্মে ঐশ্বরিক অধিকার বলে পুরুষই কর্তা। নিপীড়িত নারীর বিদ্রোহের যেকোনো চেতনা দমন করার জন্য স্রষ্টার ভীতি বরাবরই পুরুষের পক্ষে আছে।’ [৭]
.
সেকেন্ড ওয়েভের আরেক বিখ্যাত নারীবাদী, গ্লোরিয়া স্টাইন্যাম ধর্মের ব্যাপারে বলেছিল–
.
‘(ধর্ম) অবিশ্বাস্য মাত্রার জোচ্চুরি। ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখুন। মৃত্যুর পরের পুরস্কারের আশায় বর্তমানে একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকা! গ্রাহক ধরে রাখার জন্য কর্পোরেশানগুলো নানা পুরস্কারের অফার দেয়, কিন্তু তারাও মরণোত্তর পুরস্কার দেয়ার বুদ্ধি বের করতে পারেনি’। [৮]
.
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে স্টাইনেমকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আজকের নারীবাদের সবচেয়ে বড় সংকট কী’? জবাবে স্টেইনেম বলেছিল –
.
‘আজকের নারীবাদীরা ধর্মের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার না। আধ্যাত্মিক হওয়া এক জিনিস, ধর্ম আরেক জিনিস। ধর্ম হলো আকাশের রাজনীতি। আমার মনে হয় নারীবাদীদের ধর্মের বিরুদ্ধে আরও কথা বলা দরকার। কারণ, আমাদের নীরবতা ধর্মকে আরও শক্তিশালী করে’। [৯]
.
নারীবাদের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের এ ধর্মবিদ্বেষ আরও তীব্র হয় তৃতীয় পর্যায়ে এসে। এ পর্যায়ে এই বিদ্বেষ আবির্ভূত হয় নানান রূপে। যার একটি হলো বিভিন্ন জগাখিচুড়ি আধ্যাত্মিকতা আর বিকল্প ধর্মবিশ্বাস’-এর প্রতি ভক্তি।
.
উইমেন, জেন্ডার এবং সেক্সুয়ালিটির প্রফেসর সুসান শ’র মতে, বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর (যেমন, গির্জা, সিনাগগ, মসজিদ) অবস্থার আলোকে বলা যায়, ‘পুরুষতন্ত্রই পৃথিবীর কর্তৃত্বশালী ধর্ম।’ আর ‘ধর্মগুলো লিঙ্গের (gender) যে ধারণা দেয় তাতে সমস্যা আছে। এই সমস্যা পুরো পৃথিবীর সমস্যা। তাই আমাদের এমন এক সংস্কার দরকার (তা বিপ্লবও হতে পারে), যা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার বেদিগুলো ভেঙে বিশ্বজুড়ে অন্তর্ভুক্তি, সাম্য, ন্যায়বিচার, শান্তি এবং ভালোবাসার এক পবিত্র আশ্রম গড়ে তুলবে।’
.
র্যাডিকাল লেসবিয়ান নারীবাদী দার্শনিক ম্যারি ড্যালির মতে, ধর্ম প্রকৃতিগতভাবেই নারীকে নিগৃহীত করে। তার ওপর যুলুম করে। ড্যালির বক্তব্য অনুযায়ী–
.
‘গির্জার কাছে নারীর সমানাধিকার চাওয়া আর কেকেকে (Ku Klax Klan) এর কাছে কালো মানুষের সমানাধিকার চাওয়া একই কথা’। [১০]
.
তার উসকানিমূলক প্রবন্ধ “Sin Big” এ ড্যালি লিখেছে,
.
‘ইংরেজি সিন (পাপ) শব্দটি এসেছে ইন্দো-ইউরোপীয় “এস/es” ধাতুমূল থেকে। এস/es অর্থ অস্তিত্বমান হওয়া (to be)। সিন শব্দের এই উৎস আবিষ্কার করার পর আমি বুঝতে পারলাম, বর্তমান পৃথিবীর ধর্ম হলো পুরুষতন্ত্র। আর পুরুষতন্ত্রের জাঁতাকলে আটকা পড়া মানুষের জন্য অস্তিত্বমান হবার পূর্ণাঙ্গ অর্থ হলো পাপ করা (to sin)’। [১১]
.
এ লেখায় ড্যালি নারীদের পাপ করায় সাহসী হতে বলছে। কারণ, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেটাকে পাপ বলা হচ্ছে, সেটাই নাকি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রতিবাদ। পুরুষতন্ত্র ধ্বংস করতে হলে ধর্মীয় বিধানগুলোকে ধ্বংস করতে হবে। কারণ, ধর্ম হলো পুরুষতন্ত্র আর পুরুষতন্ত্র হলো ধর্ম। এ দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। একটাকে ধ্বংস করা মানে অন্যটাকেও ধ্বংস করা।
.
নারীবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো এ ধরনের কথাবার্তা দিয়ে ভর্তি। এগুলো সব একসাথে করতে গেলে কয়েক ভলিউমেও হয়তো ফুরাবে না। মুসলিম নারীবাদীদের মধ্যেও আমরা এই ধর্মবিদ্বেষ দেখতে পাই, বিশেষ করে পঞ্চম ধাপে গিয়ে। আসলে যত যাই হোক, শিষ্য তার গুরুর কাছ থেকেই শেখে...।
.
নারীবাদী দর্শনের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে ধর্মের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং শ্লেষাত্মক মন্তব্য। নারীবাদের ইতিহাস থেকে ধর্মবিদ্বেষকে আলাদা করার উপায় নেই। একজন মুসলিম যখন এই আদর্শকে গ্রহণ করবে তখন তা অবশ্যই তার ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং নষ্ট করবে।
.
(ইন শা আল্লাহ চলবে)