আধুনিক সমাজ ও আমাদের একাকীত্ব

আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা, পরিবার, আত্মীয়হীনতা ও স্বার্থপর আমরা 


 মানুষ একা বাস করতে পারে না। সবার সাথে মিলে মিশে বসবাস করে। মানুষের প্রয়োজনে ব্যক্তি থেকে পরিবার গড়ে উঠে, অতঃপর পরিবার থেকে সমাজ। আত্মীয়স্বজন- প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব নামক ইউনিট গুলো তৈরি হয়। প্রতিটি ইউনিটের পরস্পরের প্রতি কিছু অধিকার আছে। এই অধিকার বজায় রাখা ও ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়েই মানুষ ইতিহাসের প্রায় ৫ হাজার বছর পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যেন সব কিছু ফিকে হয়ে আসছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে সকল বন্ধন ও সম্পর্ক। সমাজটা যেন এখন পুরো egocentric তথা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।

Pics: Freepic | Muslim Family Picture
মুসলিম পরিবার পিক 

প্রথমে মানুষ সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা ভুলে যায়। অতপর নিজ ঘরে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা শুরু করে। এতে কয়েক বিঘত দূরত্বে বসবাস করা সত্ত্বেও যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয় প্রতিবেশীদের সাথে। পাশের বাসায় বা ঘরে থাকা লোকের খোঁজ নেয়ার কথা আমরা ভুলে গেছি। ভুলে গেছি তাদের অধিকারের কথাও। অতপর ফাটল ধরে আত্মীয়তার সম্পর্কে। মানুষ নিজ আত্মীয়স্বজনকেও ভুলে বসে। 


নিজ জীবন ও পরিবারের মধ্যে ডুবে থাকতে, দুনিয়ার পিছনে ছোটার ব্যস্ততায় নিকট আত্মীয়র হাল হাকিকত জানার আর সময় হয়ে উঠে না আমাদের। একে অপরের ঘরে যাতায়াত হয় না। পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দেয়া মোবাইল ফোন নামক যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও কয়েক সেকেন্ড সময় হয় না তাদের খোঁজ নেবার। 


কোনো অকেশনে সাক্ষাৎ হলেও কিসের জড়তায়, কিসের ব্যস্ততায়, কথা বলা হয় না মন খুলে। আর বন্ধু বান্ধবের কথা কিই-বা বলি। যে বন্ধুরা হতে পারত জান্নাতের সঙ্গী, জীবন-মরণের সাথী। সে বন্ধু নির্বাচন হয় এখন স্বার্থের ভিত্তিতে। হোক তা স্কুলে, কলেজে বা ভার্সিটিতে। হোক তা খেলার ময়দানে বা গন্তব্যে চলার পথে। যার দ্বারা কোনো স্বার্থ পূর্ণ হবে তাদেরকেই এখন বন্ধু বানানো হয়।


প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের পরে মানুষের সবচে নিকটবর্তী ইউনিটের মাঝে ফাটল ধরা শুরু হয়। সবচে 


নিকট স্বজন তথা রক্তের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। মা-বাবার সাথে সন্তানের, ভাই-বোনের, স্বামীর সাথে স্ত্রীর। এক বাসায় একই ছাদের নিচে থেকেও সবাই নিজ নিজ আলাদা পৃথিবীতে বসবাস করে। সেখানেও নিজ স্বার্থ রক্ষা করে ফিরে। 

সামান্য স্বার্থের জন্য রক্তের সম্পর্ক ভুলে যেতে সময় লাগে না এখন। ভাই ভাইকে ভুলে যায়। কেউ থাকে অতি সুখে তো কেও থাকে অভাব অনটনে। বৃদ্ধ বাবা-মা'র সেবা শুশ্রূষা তো বহু দূরের কথা, সামান্য সময় তাদের পাশে বসে কথা বলতেও বিরক্ত বোধ করে। 


স্বীয় নফসের কামনায়, দুনিয়াবি বস্তুবাদী স্বপ্ন পূরণের তাড়নায় মানুষ ছুটতে থাকে অবিরত। সামান্য অবসর পেলে বাস্তব জগতকে দূরে ফেলে ফেইক ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করে। সকল বন্ধন ভেঙ্গে সে হয়ে পরে একা, নিঃসঙ্গ। এই সময় সে হতাশায় ডুবে যায়। 


সে নিজেকে তখন আরো গুটিয়ে নেয়, ভাবে এটাই নিরাশা নিরাময়ের পথ। কিন্তু সে ভুলে যায় স্বার্থ, হিংসা, অহংবোধের জিনজির ভেঙ্গে মুক্ত হয়ে, নিঃস্বার্থ অন্তরে পরিবারের সাথে মিলিত হওয়াতেই তার নিরাময় রয়েছে।


যে সমাজ আজ যত বেশি উন্নত, সভ্য! ও আধুনিক সে সমাজের মানুষ আজ তত বেশি নিঃসঙ্গ ও আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন। কয়েক যুগ আগে আমেরিকা ও পশ্চিমা রাষ্ট্রের যে অবস্থা ছিল তা এখন আমাদের এবং বাকি মুসলিম দেশের অবস্থা হয়ে দাড়িয়েছে। 


সামাজিক ব্যবস্থার পর এখন পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। একা মানুষ যে কত দুর্বল হয়ে পড়ে, তা তারা এখনো উপলব্ধি করতে পারে না। কোটি মানুষের মাঝে থেকেও মানুষ আজ একা, নিঃসঙ্গ।


যাইহোক, এ তো হল তাদের সাথে সম্পর্কের কথা যাদের দেখা যায়, ছোঁয়া যায়। যাকে দেখা যায় না সে মহান রবের সাথে সম্পর্ক তো অনেক আগেই ছিন্ন হয়ে পড়েছে। 


দুনিয়াবী স্বার্থ পূরণে যাদের প্রয়োজন তাদেরকেই যখন ভুলে যাচ্ছে এই যুগের মানুষ, তখন আল্লাহকে কী করে মনে রাখবে? কী করে সিজদায় লুটিয়ে বন্ধন রক্ষা করবে? আজিব এক বিশ্বে আমরা বাস করছি। 


মানব জাতির ইতিহাসে মানুষ কখনোই এমন স্লেফ-সেন্ট্রেড, রোবোটিক ও সেলফিশ ছিল না, যেমনটা আজ হয়ে পড়েছে। হাদিসের প্রতিটি ভাষ্য আজ সত্যে পরিণত হচ্ছে। অচিরেই মহা ফিতনার প্রকাশ পাবে। আল্লাহুল মুস্তা'আন।

- Kaisar Ahmed 

Next Post Previous Post