ভূ রাজনীতি ও বাংলাদেশঃ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কোন ব্লকে? চীন রাশিয়া নাকি ভারত আমেরিকা?

ভূ রাজনীতি ও বাংলাদেশ ২০২৪

  1. বাংলাদেশের ভূ রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব
  2. বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব
  3. বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব
  4. ভূ রাজনীতি ও বাংলাদেশ

আসন্ন নতুন বিশ্ব বিন্যাসে বাংলাদেশ কোন ব্লকে রয়েছে, চীন-রাশিয়ার ব্লকে নাকি ভারতের হাত ধরে আমেরিকান ব্লকে?
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদিও বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ততটা গুরুত্ব রাখে না, কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বাংলাদেশের জনগনের জন্য বিশেষ করে দ্বীনি মহলের জন্য বাংলাদেশের অবস্থান খুব বড় একটি বিষয়।

 বরাবরই এদেশের দ্বীনি মহল ও জনগণ বাংলাদেশকে ভারতের আনুগত রাষ্ট্র মনে করে। ভারত যা চায় সেটাই দেশে হয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকেও ভারতপন্থী মনে করা হয়।


 প্রশাসনিক ব্যবস্থায়, সরকারী পদে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সেকটরে ইন্ডিয়ানপন্থীদের নিয়োগ দেয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ভাবে সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়া, এবং ভারতের দ্বারা অবিরত শোষিত হওয়া সব কিছু দেখে বাংলাদেশকে ভারতের একটি প্রক্সি-স্টেট ভাবতেই অধিকাংশ মানুষ পছন্দ করে।

বাংলাদেশ কোন ব্লকে? চীন রাশিয়া নাকি ভারত আমেরিকা?

এমনকি অনেকে মনে করে যে, ভারত ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আগ্রাসন চালাবে, দখল করে একটি রাজ্য বানাবে, এবং মুসলিমদের হত্যা করবে। মাঠ পর্যায়ের অবস্থা দেখলে এমন শঙ্কা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। 

আর এই শঙ্কাকে আরো পাকাপোক্ত করতে শাহ নেয়ামতুল্লাহর কাসিদাতে জোর করে বাংলাদেশকে ঢুকানোর এক চেষ্টাও আমরা করেছি। প্রথমে আমিও এমনটা ভাবতাম।

আলহামদুলিল্লাহ পরে জিওপলিটিক্স এবং শেষ যামানার হাদিসের আয়নায় বিষয়কে ভালো ভাবে দেখলাম, তখন বাস্তবতা সামনে ভেসে উঠল। পুরো সিনারিয়ো আমার বুঝে আসল।

২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশের সফরে আসেন। এই সফর ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ চীনের ব্লকে থাকবে এটা নিশ্চিত করার জন্যই চীনা প্রেসিডেন্ট এদেশে আসেন। 
এই সময় বাংলাদেশের সাথে 'স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ' সম্পর্ক চুক্তি হয়। বেল্ট এন্ড রোড প্রজেক্টে বাংলাদেশ যুক্ত হয়। তখন আমি বাংলাদেশ যে ভারত থেকে বের হয়ে চীনা ব্লকে অবস্থান নিয়েছে তা নিয়ে লিখেছিলাম।

যাইহোক, সময় গড়াতে থাকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে থাকেন। কিন্তু ভারতের সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক থাকার কারনে ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক আগের মত টিকে থাকে।

 ওদিকে চীনের 'কোয়াইট ইকোনোমিক বিল্ডআপ' পলিসি থেমে যাচ্ছিল। আমেরিকার সাথে সংঘাতের আশঙ্কা দিন দিন বেড়ে চলছিল।

 ভারত হল চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার গড়া ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির একটি সদস্য রাষ্ট্র। চীনের প্রেসিডেন্ট ২০১৮ সালে উহানে মোদীর সাথে মিটিং করেন, তিনি পরিষ্কার ভাবে আসন্ন সংঘাতে ভারতকে নিরপেক্ষ থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু ভারত তা মানলো না।

 চীন তার স্ট্রাটেজিক প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে থাকে। এক এক করে ভারতের সকল প্রতিবেশী দেশকে নিজ ব্লকে নিয়ে নেয়। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও মালদ্বীপের পোর্টে কাজ করার ফলে ভারত মহাসাগরে চীন অবাধে চলাফেরার সুযোগ পায়। ওদিকে জিবুতি ও পাকিস্তানের জন্য আরব সাগরেও শক্তি প্রতিষ্ঠা করে তারা। 

বাংলাদেশের পোর্ট নিতে তারা অনেক প্রচেষ্টা করে কিন্তু হাসিনা সরকার তখন এই বড় চাপ নিতে সক্ষম ছিল না। 

অতঃপর বাংলাদেশকে সাবমেরিন দিয়ে, সাবমেরিন বেইস বানানোর নাম করে ঠিকই  চীন নিজ উদ্দেশ্য হাসিল করে। এছাড়া পায়রা বন্দর এবং নেভির জন্য একটি নেভাল বেইস নির্মাণেরও কাজ করছে তারা।

একটি রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সেকটর হলঃ-

১। প্রশাসন
২। অর্থব্যবস্থা, ও
৩। প্রতিরক্ষা

এই তিনটির মধ্যে আবার অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল অর্থ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বলা যায় এই দুটির মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারলে অথবা নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারলে প্রশাসন নিজে নিজেই নিয়ন্ত্রণে এসে পড়ে। 

বাংলাদেশের সবচে বড় ট্রেডিং পার্টনার হল চীন। অন্যান্য সকল দেশের চাইতে চীনা বিনিয়োগ এখানে সবচে' বেশি। দেশের সবচে' বড় পুজিবাজারের ২৫ শতাংশের মালিকানা চীনের। দেশের প্রায় সকল বড় বড় প্রজেক্টে চীনা কোম্পানি কাজ করছে। 

সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশের ৫ টি শহরকে চায়না সিস্টার সিটি বানানোর পস্তাবও দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত পুরোটা চীন সেন্ট্রিক। মিলিটারি ওয়েপন ও ট্রেইনিং প্রধানত চীন থেকেই নেয়া হয়।

 রাশিয়ারও স্টেক আছে এতে। এই দুটি সেকটরে আধিপত্য লাভের পর প্রশাসন নিজে নিজে চীনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য ছিল। কিন্তু হাসিনা প্রশাসন চীন-ভারত দুই পক্ষকে সাথে নিয়ে কাজ করতে চাইতো। 

২০১৫ থেকে ২০১৮ এই চার বছর প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে টিকে থাকার লড়াই করে। পরিশেষে ভারতের অবহেলা ও চীনের ঋণ প্রশাসনকে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য করে।


২০১৯ এর নির্বাচনে বাংলাদেশে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ভারত স্বাভাবিক ভাবে হাসিনা ক্ষমতায় আসুক সেটা চাইতো। হাসিনা আসার পর ভারত খুশীও হয় তবে নির্বাচনের রাতেই ভারত উপলব্ধি করে এই সরকার ভারতের সাপোর্টে বা প্লানে ক্ষমতায় আসেনি।

 বরং নির্বাচিত হবার পুরো ক্রেডিট হল চীনের। তাই তো চীনা রাষ্ট্রদূত সবার আগে হাসিনাকে অভিনন্দন জানাতে পৌঁছে যায়। বিরোধীদলরা বিশ্ব রাজনীতি বুঝতে পুরো ব্যর্থ হয়, তারা চীনকে ত্যাগ করে ব্রিটেন ও আমেরিকার দরজায় কাড়া নাড়ছিল। 

এতদিনে যে বাংলাদেশে পশ্চিমাদের শক্তি শেষ হতে চলেছে তারা তা বুঝতে পারল না।
নির্বাচিত হবার পর সরকার প্রশাসনে ব্যপক পরিবর্তন আনে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতপন্থীদের মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেয়, নতুবা দুর্বল মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব প্রদান করে। উপদেষ্টাদের মধ্যেও ভারতপন্থীদের আধিপত্য কমে যায়।

 এমনকি পরবর্তীতে দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়। ভারত এই বিষয়গুলো ভালো ভাবে বুঝতে পারলো। ভারতে CAA ঘোষণার পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফর বাতিল করে, পররাষ্ট্র সচিবও সফর স্থগিত করে।

 এ থেকে ভারতে খুব শক্ত মেসেজ পৌঁছে। মোদি তখনো অন্ধকারে থাকতে চাইলো। মমতা ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে দূরত্বের ফলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের ফাটল বন্ধ করা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

করোনার কালে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ফাটল উভয় দেশের কাছে স্পষ্ট হতে লাগলো। শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতের জন্য ভারতীয় রাষ্ট্রদূত চার মাস ধরে চেষ্টা করেও একটি এপয়েনমেন্ট পেল না। বাংলাদেশে ভারতীয় প্রজেক্ট গুলো প্রায় থেমে গেল। 

চীনের সাথে সংঘর্ষে ভারতের ২০ সেনা মারা যাওয়ার পরও বাংলাদেশ কোনো বিবৃতি দিল না। বরং বাংলাদেশে সীমান্তে হত্যা বন্ধে পররাষ্ট্রমন্ত্রি ভারতকে হুঁশিয়ারি দিল, স্পর্শকাতর এরিয়াতে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন করা হল।

 এমনকি রাম মন্দির নির্মাণ থেকে ভারতকে বিরত থাকতে বলা হল। চীনের প্রধান মিত্র পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হতে লাগল। মোদি ফাটল কমাতে ফরেন সেক্রেটারিকে বিশেষ ভাবে বাংলাদেশে পাঠায়।

 পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো মাত্র তিন মাসে বাংলাদেশের এতটা পরিবর্তন দেখে শ্রিংলা নিজেই অবাক হয়। তাকে কেউ রিসিভ করতে যায়নি। 

ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় থেকে সাক্ষাত লাভ করতে পারলেও, না হলো কোনো বিশেষ কথা, গলানো গেল না বরফ বরং একটি ছবিও তোলা হল না। কোনো প্রেস রিলিজও হল না।


এই সব কিছুই মোদিকে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে, বাংলাদেশ এখন তার হাতে নেই। ভারত 'লুক ইষ্ট পলিসি' তৈরি করেছে, কত কল্পনা-জল্পনা করে রেখেছে। কিন্তু ইষ্টের প্রথম রাষ্ট্র বাংলাদেশই যদি তাদের সাথে না থাকে তা হবে ভারতের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ। 

মোদি শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে হয়তো আজিত ডোভেলকে বাংলাদেশে পাঠাতে পারে, তবে তাতেও কাজ হবে না। উভয় দেশের মধ্যে যা বাকি আছে এবং থাকবে তা হল ভারতের সাথে শুধুমাত্র ঐতিহাসিক ও সামাজিক সম্পর্ক।

 যা আভ্যন্তরীণ সম্পর্কে কিছু গুরুত্ব রাখলেও জিওপলিটিক্সে তেমন গুরুত্ব রাখে না। আর সাধারন ব্যবসা-বাণিজ্য, ও সাধারণ সুযোগ-সুবিধার আদান-প্রদান শত্রু রাষ্ট্রের সাথেও বিদ্যমান থাকে। 

উল্লেখ্য যে, ভারতের সাথে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ মাঠ পর্যায়ে এখনও তেমন দেখা যায়নি, দিন যত যাবে মাঠ পর্যায়ে আমরা তা দেখতে পাবো।

ভবিষ্যতে ভারত কি বাংলাদেশে হামলা করবে?
এবার এই প্রশ্নে আসা যাক। ভারত কোনো সুপার পাওয়ার রাষ্ট্র না। দারিদ্রতা ও নানান দুর্নীতি, বেকারত্ব, অনিয়ম, বর্ণবাদ, ধর্মবাদে আক্রান্ত ভারতের মিলিটারি ততটা শক্তিশালী নয় কাগজ কলমে যতটা মনে হয়।

 তারা পাকিস্তান ও চীনের দ্বারা খুব চাপে আছে। ভারতের পশ্চিম ও উত্তর সীমান্ত সুরক্ষিত নয়, সেখানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের অধিকাংশ সেনা প্রস্তুত রাখতে হয়। পাকিস্তান ও চীনের হামলার আশঙ্কা রয়েছে সেখানে। 

কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণে রাখতে লক্ষ-লক্ষ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে ভারত। এছাড়া সেভেন সিস্টার্স সহ প্রায় ১৫টি রাজ্যে মাওবাদীদের দমন করতে হয়। খালিস্তান সহ অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনা রুখতে হয়।

 এই রকম ২.৫ ফ্রন্ট ওয়ারের আশংকায় থাকা ভারত বাংলাদেশে হামলা করবে, এক নতুন ফ্রন্ট খুলবে তা চিন্তা করাও ভারতের জন্য অসম্ভব। তার কাছে আলাদা মিলিটারি পাওয়ার নেই যা পূর্ব সীমান্তে মোতায়েন করবে।

 নানান সমস্যায় আক্রান্ত ভারত নিজ রাজ্যগুলোকেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র কায়েমের পথে ভারতের ২৫ কোটি মুসলিমের বাঁধা তাদের কাছে অনেক বড় একটি সমস্যা।

 এর মাঝে তারা বাংলাদেশের ২০ কোটি মুসলিমকে শত্রু বানাতে পারবে না। তাদের কাছে এমন শক্তিও নেই যে বাংলাদেশে হামলা করতে পারবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ভারত আক্রমণ করবে এমনটা আমি মনে করি না।

আমার এই বিশ্লেষণ হল বিশ্বযুদ্ধের পূর্বের অবস্থা নিয়ে। আসন্ন বিশ্বযুদ্ধে বাংলাদেশ একটি ফ্রন্ট লাইনে পরিণত হবে। যেখানে চীনা এবং আমেরিকান ব্লকের মাঝে খুব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হবে। তখন পরিস্থিতি হবে পুরোপুরি ভিন্ন।
- Kaisar Ahmed
Next Post Previous Post