বাংলাদেশি তথা বাঙালি মুসলিমদের ইতিহাস ও সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহই আমাদের দায়িত্ব। অবিভক্ত মুসলিম বাংলা
- বাঙালি মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামী
- বাঙালি নাকি মুসলিম?
- বাঙালি মুসলিম এর ইতিহাস
- বাঙালি ও মুসলিম
লেখক-Monem Ibn Mohammed
“If you don't know history, then you don't know anything. You are a leaf that doesn't know it is part of a tree”.
অর্থাৎ
আপনি যদি ইতিহাস না জানেন, তবে আপনি কিছুই জানেন না। আপনি এমন একটি পাতার মত যেটি জানে না যে সে একটি গাছের অংশ।
কথাগুলো বলেছেন একজন বিখ্যাত আমেরিকান লেখক ও চিত্রনির্মাতা, জন মাইকেল ক্রাইটেন (John Michael Crichton)। বাংলাদেশী মুসলিমদের নিজস্ব ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতাকে এর চেয়ে উত্তম শব্দসমূহ দ্বারা হয়ত প্রকাশ করা যাবে না।
বিখ্যাত চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস (Confucius) বলেছেন -” অতীত সম্পর্কে পড় যদি তুমি ভবিষ্যৎকে গড়তে চাও”। অর্থাৎ, কোন জাতি যদি ভবিষ্যতে দুনিয়ার বুকে প্রভাবশালী হতে চায় তবে সেই জাতিকে অতি অবশ্যই নিজেদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে গভীর চর্চা করতে হবে।
ইতিহাস চর্চায় সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য পাবে সেই সময়ের আলোচনা যখন সেই জাতি ক্ষমতা ও গৌরবের শীর্ষে ছিল। যে জাতি নিজেদের গৌরবময় অতীত ইতিহাস ও সাহিত্য সম্পর্কে জানে না এবং তা নিয়ে গর্বিতও হয় না তাদের ব্যাপারে বিখ্যাত জার্মান ভাষাবিজ্ঞানী ও ওরিয়েন্টালিস্ট ফ্রেডরিখ ম্যাক্স মূলার (Friedrich Max Müller) বলেছেনঃ
“A people that can feel no pride in the past in its history and literature loses the mainstay of its national character”.
অর্থাৎ
যে জাতি নিজেদের অতীত ইতিহাস এবং সাহিত্য নিয়ে কোন গর্ব অনুভব করে না, সে জাতি তাদের জাতীয় চরিত্রের মূল ভিত্তি হারাতে থাকে।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে যে, বাংলাদেশী মুসলিমদের জাতীয় চরিত্রের মূলভিত্তি কি? ইসলাম নাকি ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)? এটির উত্তরে আমি বলব, ৯০% মুসলিমের এই দেশে অধিকাংশ মুসলিম কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে? সেকুলার ডিনমিনাল (Denominal, অর্থাৎ নামসর্বস্ব) মুসলিম পরিচয় নাকি নিবেদিত ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিচয়? অতি অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সবাই নিজেদের ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিবে।
এমনকি, অনেকেই এই ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিচয়কে তাদের বাংলাদেশী পরিচয়ের ঊর্ধ্বে রাখবেন। এর ব্যতিক্রম পাওয়া দায়, এমনকি ধর্মের সাথে দূরদূরান্তের সম্পর্ক নেই এমন লোকও এই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে ও গর্বিত হবে।
শাহ জালাল (রহঃ) ও শাহ পরানের (রহঃ) এই দেশে এটাই আমাদের জাতীয় চরিত্র, আমরা ধর্মপ্রাণ মুসলিম। সুতরাং, আমাদের জাতীয় চরিত্রের মূল ভিত্তি হল ইসলাম। যতই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে সেকুলার ও সেকুলারিজমের স্বর্গরাজ্য হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা হোক না কেন, প্রকৃত সত্য এটাই যে খানেল আজম খান জাহান আলীর (রহঃ) সংগ্রাম ও দাওয়াহ’য় সিক্ত এই মাটি ও তার মানুষ ইসলামকে এখনও অনেক বেশীই ভালোবাসে।
সুতরাং, কোন জাতি যদি দুনিয়ার বুকে প্রাসঙ্গিক থাকতে চায় ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করতে চায় তাহলে তাদেরকে নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। অবশ্যই এই ইতিহাসকে সেই জাতির জাতীয় চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, হতে হবে জাতীয় চরিত্রের মূল সিঞ্চনকারী।
ইতিহাসের পাঠ্যক্রম এমন হতে হবে যেন তা সম্মিলিত জাতীয় চেতনাকে নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলে। মুসলমানিত্ব বাংলাদেশের জাতীয় চরিত্র, তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠ্যক্রমে বাংলার ইসলামী শাসনকে অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত।
কিন্তু, তা কি হচ্ছে? দেশভাগের সময় বাংলাদেশের মুসলিমরা বাংলায় ইসলামী শাসনের ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ দুটি জেলা হারিয়ে ফেলল, মালদহ ও মুর্শিদাবাদ, যদিওবা সেগুলো ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি জেলা।
এই দুটি জেলার সাথে আমরা হারিয়ে ফেললাম বাংলার ইসলামী শাসনের শাহী সব রাজধানী ও শহর, যেমনঃ গৌড়, পাণ্ডুয়া ও মুর্শিদাবাদ; শুধুমাত্র বাগেরহাটের খলিফাতাবাদ আমরা ভাগে পেলাম। এভাবেই গৌরবময় ইসলামী স্থাপত্যে ভরপুর শহরগুলো হারিয়ে আমরা হয়ে উঠলাম মাইকেল ক্রাইটেনের সেই আত্মপরিচয়হীন ঝরা পাতার মত।
এই দুর্দশা হতে পরিত্রাণ পাওয়া যেত যদি আমাদের পাঠ্যসূচিতে এই গৌরবময় সময়টুকুকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া হত। দীর্ঘকাল ধরে ব্রিটিশদের নির্মম নিষ্পেষণে জর্জরিত হয়ে আত্মপরিচয় ভোলা এই জাতি পেত তার নাড়ির খোঁজ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে, এই সময়টুকু আমাদের পাঠ্যসুচিতে খুবই অবহেলিত। যেকোন জাতির ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যথাঃ স্বাধীনতার ইতিহাস ও পরাধীনতার ইতিহাস। এটাই স্বাভাবিক যে, কোন জাতির ইতিহাস চর্চায় স্বাধীন সময়টুকুর ইতিহাস পরাধীন সময়টুকুর চেয়ে অনেক বেশী আলচিত হবে।
আমাকে ভুল বুঝবেন না, পরাধীন সময়ের সংগ্রাম, সংঘাত, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও তার রথী-মহারথীদের গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা অবশ্যই জরুরী, কিন্তু তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী জরুরী নিজেদের স্বাধীন সময়টুকু নিয়ে আলোচনা করা।
দু’একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। গ্রীসের পাঠ্যসূচিতে কোন সময়টিকে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, গ্রীক ক্লাসিক্যাল যুগ নাকি উসমানী খিলাফতের অধীনে থাকা যুগ? রাশিয়া তার ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে কোনটিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে, রাশিয়ান সাম্রাজ্য বিস্তারের যুগ নাকি মঙ্গোলদের হাতে পরাধীন থাকার যুগ? উত্তরগুলো কি হবে আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন।
ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী (রহঃ) এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইসলামী শাসনের শুরু, যা প্রায় সুদীর্ঘ ৫০০ বছর ধরে চলমান ছিল। এই সুদীর্ঘ সময় ছিল বাঙ্গালী মুসলিমের স্বাধীনতার যুগ। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর দেশ ভরা শান্তি।
বাঙ্গালী তথা বাঙ্গালী মুসলিমের ভাষাগত পরিচয় হতে বড় বড় সব জাতীয় অর্জন এই সময়েই অর্জিত হয়েছিল, বিকশিত হয়েছিল স্বকীয় ইসলামী স্থাপত্যকলা, মসলিন, জাহাজশিল্প, রেশমশিল্প থেকে মাইনিং (Mining) পর্যন্ত।
কেননা, জাতীয় অর্জন এবং পরিচয় এই দুয়ের জন্যই শর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা, যা ইসলামী শাসনামলে ছিল। বাংলার সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায়-ই বাঙ্গালী সাহিত্য হয়ে উঠে সমৃদ্ধ, নতুন প্রাণ আসে বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে। দুনিয়ার অন্যতম সম্পদশালী এই অঞ্চলের মানুষদের তখন অন্যরকম মর্যাদা ছিল, সবাই সমীহ করে চলত এই বাঙ্গালীদের।
অথচ, আজ পাঁচশত বছরের মর্যাদাপূর্ণ এই সময়টুকুর কোন দাম নেই আমাদের কাছে। ইতিহাসের বইয়ে অল্প কিছু পৃষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ থাকে এর পাঠ, আর বাকিটা জুড়ে শুধুমাত্র পরাধীনতার কাল।
বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস পাঠ্যসূচি মূলতঃ ১৭৫৭ থেকে ১৯৭১ কেন্দ্রিক। সারাটি জীবন শুধুমাত্র এই বিভীষিকাময় সময়ের নির্যাতন-লাঞ্ছনা, যুদ্ধ-সংঘাত, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বিসর্জনের ইতিহাস পড়ে যাই আমরা।
এর আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় নিজেদের মহাগৌরবময় ইতিহাসটুকু। ভারতে নিযুক্ত ইংরেজ লর্ড ও ভাইসরয় সবার নাম আমরা জানি, কিন্তু সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ’র একজন সুলতানের নামও আমরা বলতে পারব কিনা সন্দেহ।
এর ফলাফল কি? নিজেদের প্রকৃত ইতিহাসকে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জাতিগতভাবে আজ আমরা ইয়াতীম। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী হওয়ার পরও গর্ব করার মত নিজেদের কোন ইসলামী ঐতিহ্যের ব্যাপারে আমরা জ্ঞান রাখি না। আমরা আজ কোটি কোটি ঝরা পাতার মত, জানি না কোন মহীরুহ বৃক্ষের অংশ আমরা, এবং ইচ্ছেও হয় না এর সম্পর্কে জানার জন্য।
একটি বীজকে মহীরুহ বৃক্ষে পরিণত হতে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তেমনি মহীরুহ বৃক্ষের মত বাংলার এই ইসলামী শাসন যার ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলে প্রায় ২৩-২৫ কোটি মুসলিম আমরা, তার পথপরিক্রমাও সরল ছিল না, অনেক জিহাদ-কিতাল, রক্ত-ঘাম, সবর-তাওয়াক্কুল ও দাওয়াহ’র ফলশ্রুতিতেই এই অঞ্চলের ইসলামের বীজ পরিণত হয় বৃক্ষে।
তাই আমাদেরকে এই বৃক্ষের নিকটই ফিরে যেতে হবে, কারণ এটিই আমাদের আসল পরিচয়, গৌরবের ইতিহাস। এর পঠনেই আমরা পাব মহান জাতিতে পরিণত হওয়ার রূপরেখা।
এখন আসি ঠিক কীভাবে নিজেদের গৌরবময় ইতিহাস চর্চা একটি সাধারণ জাতিকে মহৎ জতিতে পরিণত করতে সহায়তা করে তার আলোচনায়। ঐতিহাসিকসূত্রে প্রত্যেক জাতিই কিছু দায়িত্ব লাভ করে উত্তরাধিকার হিসেবে। ইতিহাস পঠন আপনাকে আপনার সেই সমস্ত দায়িত্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে।
একটি জাতি তার জাতীয় দায়িত্বের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারে ইতিহাস পঠনের মাধ্যমেই । ইংরেজিতে Man-Up বলে একটা কথা আছে, অর্থাৎ দায়িত্ব নেয়ার মত মেচুরিটি (Maturity) অর্জন করা। আপনি যখন আপনার দায়িত্ব সম্পর্কে জানবেন, তা পালনের জন্য যথাযোগ্য চেষ্টা চালাবেন তখনই আপনি মেচুরিটি অর্জন করবেন।
আপনি যখন এই মেচুরিটি অর্জন করবেন তখনই কেবল নিজেকে শক্তিশালী অবস্থানে নেয়ার জন্য কাজ করতে পারবেন। তেমনি একটি জাতির ক্ষেত্রেও সমীকরণটা একই রকম; পৃথিবীর বুকে মহান ও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার জন্য দরকার জাতীয় মেচুরিটি।
এই মেচুরিটি তখনই আসবে যখন জাতীয় চেতনা ঐতিহাসিকসূত্রে পাওয়া জাতীয় দায়িত্বগুলোর ব্যাপারে সচেতন হবে। যখন সে বুঝতে পারবে যে, এই দায়িত্বসমূহ সে তার গৌরবময় অতীতের উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, এবং যখনই সে পালিয়ে না গিয়ে এই সমস্ত দায়িত্বগুলোকে আনন্দের সাথে আলিঙ্গন করবে তখনই মহান হওয়ার পথে অনেকখানি এগিয়ে যাবে সে।
আর আপনার অতীত স্বর্ণালী ইতিহাসই আপনাকে খোঁজ দিবে এই সমস্ত মহান দায়িত্বের। গৌরবময় ইতিহাসের লিগ্যাসি (legacy) যেমন অনেক বড়, তেমনি এই লিগ্যাসিকে ধারণ করার জন্য অনেক গুরু দায়িত্বও কাঁধে নিতে হয়। নিচে কিছু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করা হল।
গত দুই দশকে দুটি ওল্ড ওয়ার্ল্ড পাওয়ারের নতুন করে উত্থান হয়েছে, যথাঃ তুরস্ক এবং রাশিয়া। এই দুটি দেশেরই বিশ্বশক্তি মঞ্চে নতুন করে আবির্ভাবের পিছনে নিজেদের স্বর্ণালী অতীত ইতিহাস ও ইতিহাসলব্ধ দায়িত্বসমূহ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।
প্রথমেই আসি তুরস্কের ব্যাপারে। তুরস্কের ইতিহাস ওসমানী সালতানাতের ইতিহাস, খিলাফতের ইতিহাস। ইসলামের প্রচার ও প্রসার, বিশেষ করে ককেশাস ও বলকান অঞ্চলে ইসলামের শক্ত ভিত এদের হাতেই স্থাপিত হয়। আজ ককেশাস ও বলকানে অসংখ্য অজস্র মুসলিম, এটি ওসমানী খিলাফতের শক্তিশালী ঐতিহ্যেরই সাক্ষ্য।
মধ্যযুগে ওসমানী খিলাফত ছিল ত্রাস সৃষ্টিকারী বিশ্বশক্তি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে তারা দুর্বল হতে শুরু করে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে খিলাফতকেই বাতিল ঘোষণা করে সেকুলার তুরস্কের জন্ম হয়।
সেকুলার হলেও ওসমানী খিলাফতের উত্তরসূরি হিসেবে তাদের দায়িত্বগুলোকে কিন্তু তারা এড়াতে পারেনি। সাইপ্রাসের তুর্কি মুসলিমরা ওসমানী খিলাফতেরই লিগ্যাসি। তাই, ১৯৭৪ সালে যখন সাইপ্রাসে যুদ্ধ শুরু হয় তখন তুর্কি সাইপ্রিয়টদের রক্ষার দায় ছিল তুরস্কের উপর, এবং তারা সেই দায়ে সাড়া দিয়ে সাইপ্রাসে নিজেদের সৈন্যবাহিনী পাঠায়।
নন-এনগেজমেন্ট বা অন্য দেশের ব্যাপারে নাক গলানো যাবে না, এই অজুহাত কিন্তু তারা দেয়নি। ১৯৯২ সালে যখন বসনিয়াতে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তুরস্ক সক্রিয়ভাবে বসনিয়াকদের সাহায্য-সহায়তা করে। আমেরিকান ব্লকে থাকা ও ন্যাটো সদস্য হওয়ার দরুন সরকারীভাবে বাহ্যিক সহায়তা তেমন না করলেও, বিভিন্ন গোপন উপায়ে সাহায্য চালু রাখে।
যেমনঃ ইরান যখন আন্তর্জাতিক অবরোধ উপেক্ষা করে গোপনে বসনিয়াতে অস্ত্র পাঠায় তখন তুরস্ক তাদেরকে সহায়তা করে অস্ত্র পাঠাতে [১]।
এছাড়া পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়শিয়া, ব্রুনেই ইত্যাদি দেশ বসনিয়াতে যে অস্ত্র, অর্থ ও ইন্টিলিজেন্স সাপোর্ট পাঠায় তার পিছনেও হাত রয়েছে তুরস্কের [২]। তুর্কি দাতব্য গোষ্ঠী রেফাহ পার্টি (Refah Party) এবং আই এইচ এইচ (IHH) এর দ্বারা বসনিয়াতে ত্রাণের একটি বড় অংশ পৌছায়, এছাড়াও তাদের কয়েকশত ভলান্টিয়ার বসনিয়াতে সক্রিয় ছিল [৩]। অন্যদিকে, বেসরকারী বিভিন্ন তুর্কি প্রতিষ্ঠানের সাহায্য-সহায়তা তো বিদ্যমান ছিলই। এছাড়া তুরস্কই প্রথম ন্যাটো সদস্য হিসেবে সার্বদের উপর বিমান হামলা ও সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তাব দেয় [৪]। শেষমেষ ন্যাটো যখন সার্বদের উপর বিমান হামলা শুরু করে তখন তুরস্ক ১৮ টি এফ - ১৬ বিমান দিয়ে সহায়তা করে [৫]।
একইভাবে কসোভোর (Kosovo) যুদ্ধেও আলবেনীয় মুসলিমদের সাহায্য করা তুরস্ক নিজেদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব মনে করে [৬]। কসোভো লিবারেশন আর্মির (KLA) বহু সদস্যকে তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা Turkish intelligence service (MIT) তুরস্কের ইজমিরে (İzmir) ট্রেনিং দেয় [৭]।
কসোভোর যুদ্ধেও সার্বদের উপর বিমান হামলা চালানোর জন্য শক্ত লবিইং মূলত তুরস্কই করে। অবশেষে যখন ন্যাটো খোদ সার্বিয়াতেই বম্বিং ক্যাম্পেইন শুরু করে তখন তুরস্ক এতে অংশগ্রহণ করে ও এই ক্যাম্পেইন সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে [৮]।
শুধু তাই নয় যুদ্ধের পর আলবেনিয়া ও বসনিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে দাঁড় করানো, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, মসজিদ তৈরি ইত্যাদি কাজেও তুরস্ক অকাতরে সহায়তা করে গেছে এবং এখনও যাচ্ছে।
নিপীড়িত মুসলিমদের সাহায্য করা উম্মাহ’র দায়িত্ব, কিন্তু এর সাথে যদি ঐতিহাসিক কারণ যোগ হয় তাহলে দায়-দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। ওসমানী খিলাফতের হাত ধরেই বসনিয়া, আলবেনিয়া ও কসোভোতে ইসলাম প্রবেশ করেছে। সুতরাং, এদের সহায়তা করা তুরস্কের জন্য ঐতিহাসিক জাতীয় দায়িত্ব।
একসময় ওসমানী খিলাফতের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোর মুসলিমদের (যেমনঃ বসনিয়া, আলবেনিয়া, কসোভো, সার্বিয়া, গ্রীস, মেসিডোনিয়া, বুলগেরিয়া, মন্টেনিগ্রো, জর্জিয়া, ক্রিমিয়া) রক্ষা করার দায়িত্ব ইতিহাসের উত্তরাধিকারসূত্রে তুরস্কের উপর দাঁড়ায়।
এতদঞ্চলের মুসলিমরা এই আশা ও অধিকার রাখে যে তারা আক্রান্ত হলে মুসলিমদের মধ্যে প্রথম জবাব তুরস্কের পক্ষ হতেই আসবে। তুরস্কে বর্তমানে ওসমানী রিভাইভালের (Revival) চেষ্টা চালানো হচ্ছে। যে কোন অতীত গৌরব ধারণ করার প্রথম শর্ত হচ্ছে সেই গৌরবময় সময় যে দায়িত্বগুলো রেখে গেছে সেগুলোকে আলিঙ্গন করা।
সুতরাং, ওসমানী খিলাফত তুর্কিদের কাছে যে সমস্ত দায়িত্ব রেখে গেছে তার মধ্যে প্রধানতম হল এর অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোতে (বিশেষত ইউরোপে) ইসলামের বিকাশে কাজ করা। এর ফলশ্রুতিতেই বসনিয়াতে যে সমস্ত মসজিদগুলো যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সেগুলো পূনঃউদ্ধারে তুরস্ক আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে [৯]। আলবেনিয়াতে তৈরি হচ্ছে বলকান অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মসজিদ [১০]।
এছাড়াও, ইসলামকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার যে খিলাফতী দায়িত্ব তা পালনের জন্য সারা বিশ্বেই তারা মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে [১১]। অন্যদিকে ওসমানী খিলাফতের সময় তুরস্ক ভূমধ্যসাগর ও মধ্যপ্রাচ্যে যেরকম ডমিন্যান্ট পাওয়ার ছিল, তার কিছুটা উদ্ধারেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা [১২]
এর পিছনে কারণ হিসেবে আপনি তুর্কি জাতীয়তাবাদ বা অন্য অনেক কিছুই উল্লেখ করতে পারেন, কিন্তু, ওসমানী খিলাফতের হারানো গৌরবকে ফিরিয়ে আনার যে অদম্য বাসনা এর পিছনে কাজ করছে তা আপনি কোন ভাবেই অস্বীকার করতে পারবেন না।
এবার আসি রাশিয়ার প্রসঙ্গে। নব্বই এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার আর কোন উত্থান হবে না বলেই সবাই ধরে নিয়েছিল। কিন্তু, ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া দখল এবং ২০১৫ সালে সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ সেই ধারণা পাল্টে দিয়েছে।
ক্রাইমিয়া দখল বা সামরিক হস্তক্ষেপ কিন্তু রাশিয়া এমনি এমনি করেনি। এর পিছনে রয়েছে রাশিয়ার গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহাসিক দায়িত্বের ইন্ধন। বর্তমানে রাশিয়ার ক্ষমতায় যারা আছে তাদের কাছে রাশিয়ার গৌরবময় ইতিহাস হল সোভিয়েত যুগ পূর্ববর্তী রাশিয়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস।
পুতিনকে অনেকে মনে করেন কমিউনিস্ট, অর্থাৎ, সে কমিউনিস্ট যুগের রাশিয়ার গুণমুগ্ধ। এটি সর্বৈবভাবে ভুল একটি তথ্য। পুতিন কমিউনিস্ট নন বরঞ্চ একজন ট্র্যাডিশনালিস্ট। সে হারিয়ে যাওয়া রাশিয়ান সাম্রাজ্যের গৌরব ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর [১৩], যে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল কমিউনিস্টদের হাতে।
এই ব্যাপারে আইডিয়া নিতে আপনারা দেখতে পারেন, “Putin's pride: Cossacks and the church; DW Documentary”, তবে অবশ্যই দৃষ্টি সংযত করে দেখতে হবে। রাশিয়ান সাম্রাজ্যের একটি প্রধান লক্ষ্যই ছিল ওয়ার্ম ওয়াটার পোর্ট, অর্থাৎ, এমন একটি বন্দর যেখানে পানি কখনও বরফ হয়ে যাবে না, এবং সব সময় নৌ-চলাচলের জন্য উপযোগী থাকবে।
ইউক্রেন থেকে ক্রাইমিয়াকে আলাদা করে রাশিয়া এই ম্যাসেজই দিল যে, সাম্রাজ্যের যুগ থেকে চলে আসা এই লক্ষ্য নতুন করে পূরণের দায়িত্ব তারা ভুলে যায়নি। সিরিয়ায় এসে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয়। পুতিনকে অনেকে নাস্তিক মনে করেন, অথচ সে খৃষ্টান ধর্মে দৃঢ় বিশ্বাসী [১৪]।
কন্সটানটিনোপল পতনের পর অর্থোডক্স ক্রিসচিয়ানিটির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায় মস্কো, অর্থোডক্সদের কাছে মস্কো হয়ে উঠে তৃতীয় রোম। সুতরাং, রাশিয়ান সাম্রাজ্যের উপর সারা বিশ্বের অর্থোডক্স খৃষ্টানদের অভিভাবকত্ব ছিল। অতএব, অর্থোডক্স খৃষ্টানদের রক্ষা করা রাশিয়ার ঐতিহাসিকসূত্রে পাওয়া দায়িত্ব। কিছু মাইনর জিওপলিটিকাল গোল বাদ দিলে সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণের পিছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে সিরিয়ার অর্থোডক্স কমিউনিটিকে রক্ষা করা [১৫]।
এছাড়া খৃষ্টান মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে সিরিয়ার খৃষ্টানদের সমস্ত স্থাপনা পুনর্গঠনের প্রতিজ্ঞাও করেছে পুতিন [১৬]। এই ব্যাপারে অনেক আর্টিকেল ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে বিধায় আর কোন কথা বাড়িয়ে আজকের লিখার কলেবর বৃদ্ধি করতে চাচ্ছি না।
সুতরাং, আমরা দেখতে পেলাম যে তুরস্ক ও রাশিয়া বিশ্ব রাজনীতির পাকচক্রে পড়ে শৌর্য বীর্য হারানোর পর কীভাবে আবার নিজেদের গৌরবময় অতীত ইতিহাসের উপর ভর করে শক্তির খেলায় ফিরে আসছে। আমরা দেখতে পেলাম যে কীভাবে তাদের জাতীয় নীতি (বিদেশ নীতি বিশেষত) ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া দায়িত্বসমূহ দ্বারা নির্ধারিত হয়।
আমরা আরও দেখতে পেলাম যে, কীভাবে মুসলিম ও খৃষ্টান উভয়েই তাদের স্বধর্মীয় ভাইদের রক্ষা করার ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধকে নিজেদের জাতীয় চেতনার অংশ হিসেবে মনে করে। এই সমস্ত দায়িত্ব পালনকে তারা নিজেদের জন্য বোঝা মনে করে না, বরঞ্চ একে নিজেদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ মনে করে।
এভাবেই জাতিসমূহ সম্মিলিত মেচুরিটি অর্জন করে। কারণ, নিজেদের গর্বের ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইলে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার সম্মুখীন হতে হয়, স্বার্থকেন্দ্রিক স্বজাতিবাদী রাজনীতি ত্যাগ করতে হয়, অন্যের জন্য অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়, বড় বড় দায়িত্ব এবং সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিও নিতে হয়, বাড়ির খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হয় অনেক।
এই প্রক্রিয়াতেই একটি জাতি হয়ে উঠে সাহসী এবং মেচিউর, হয়ে উঠে বিশ্বের বুকে প্রভাবশালী। সুতরাং, আমরা প্রমাণ করলাম যে একটি জাতির পুনঃউত্থান তখনই সম্ভব যখন সে তার ইতিহাস ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পর্কে জানবে ও সচেতন হবে।
বাংলাদেশী মুসলিম জাতির ইতিহাস, বিশেষতঃ গর্বের ইতিহাস কি তা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। তো বাংলাদেশী মুসলিমরা ইতিহাসের উত্তরাধিকারসূত্রে কোন দায়িত্বগুলো পেয়েছে? এটাই আসল প্রশ্ন এখন।
এর উত্তর দেয়ার আগে আমাদের স্বর্ণালী যুগ সম্পর্কে আরেকটু আলোচনা করে নিই।
বাংলার ইসলামী শাসনকে মোটাদাগে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
১/ দিল্লী সালতানাতের অধীনে থাকা যুগ,
২/ স্বাধীন সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ’র যুগ,
৩/ মুঘল সালতানাতের অধীনে থাকা যুগ,
৪/ স্বাধীন নওয়াবদের যুগ।
এই চার যুগের মধ্যে সবচেয়ে ভালো যুগ ছিল সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ’র যুগ। দুইশ বছর ধরে চলা এই যুগে বাংলার প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। এই যুগের শাসকরা মুঘলদের চেয়ে অনেক বেশী ইসলামভীরু ছিলেন। ইসলাম প্রচারে জিহাদ-কিতাল এদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছিল বেশী। আসামের কামাখ্যা থেকে উড়িষ্যার জগন্নাথ পুরি সর্বত্রই তারা ছিলেন বিজয়ী। নেপাল ইতিহাসে মাত্র একবার মুসলিম শক্তি দ্বারা বিজিত হয়, এবং এর কৃতিত্ব শুধুমাত্র সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ’র।
আজকের বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, আরাকান, আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা সহ উত্তরপূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোতে যত মুসলিম তা এই যুগে সংঘটিত অসংখ্য জিহাদ-কিতাল-দাওয়াহ, শহীদ-গাজী ও দাঈ’র বদৌলতে অর্জিত হয়েছে। এমনকি, বিহার, উত্তর প্রদেশেও পা পড়েছিল বাঙ্গালী সুলতানদের।
বাংলায় স্বাধীন ইসলামী সালতানাত থাকা অবস্থাতেই বিগ্রহ বিনাশকারী মোহাম্মদ ফারমুলির (কালাপাহাড়) হাত ধরে উড়িষ্যাতে ইসলামের প্রবেশ, আজ তা লক্ষ লক্ষ মুসলিমের বিশাল এক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। শাহ জালাল (রহঃ) এর জিহাদ ও দাওয়াহ’র মাধ্যমেই শ্রীহট্টতে ইসলামী শাসনের শুরু হয় যা আরও শক্তিশালী হয় বাঙ্গালী সুলতানদের হাতে; আজকের সিলেট ও আসামের কয়েক কোটি মুসলিম এরই ফসল।
খান জাহান আলীর (রহঃ) দাওয়াহ ও জিহাদের ফলেই দক্ষিণবঙ্গ এসেছে ইসলামের সুশীতল ছায়ায়। আরাকান বাংলা সালতানাতের পুতুল রাষ্ট্রে পরিণত হবার পর যে সমস্ত মুসলিমদের সুলতানরা সেখানে পাঠিয়েছিলেন উপদেষ্টা ও যোদ্ধা হিসেবে তারাই আজ বিশাল রোহিঙ্গা জাতিতে পরিণত হয়েছে।
তাই আমার মতে এই স্বর্ণালী যুগটিই আমাদের জাতির ইতিহাসে সর্বোৎকৃষ্ট সময় ছিল। এই সময় পৌত্তলিক ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের বীজ রোপিত হয় বাংলা সালতানাতের মাধ্যমে। কালক্রমে এই সমস্ত বীজ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে, পরিণত হয়েছে এক সুন্দর বাগানে; কোটি কোটি মুসলিম ও তাঁদের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক বাগান।
মালিকের প্রয়াণের পর বাগানের মালিকানা চলে যায় তার উত্তরসূরির কাছে, এই উত্তরসূরির দায়িত্ব হচ্ছে বাগানের দেখভাল ও পরিচর্যা করা এবং এর পরিবর্ধন করা। একই ব্যাপার বাংলাদেশী মুসলিমদের জন্যও খাটে। সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ’র উত্তরসূরি হিসেবে আমরা পেয়েছি ভারত-বাংলাদেশের বুকে রেখে যাওয়া তাঁদেরই তৈরি করা ইসলামের এই বাগান। তাই, সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ’র গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা পেয়েছি অনেকগুলো দায়িত্বও।
কি সেই দায়িত্বগুলো? অনেকগুলো দায়িত্বের মধ্যে নিচে কয়েকটি মাত্র আলোচনা করলামঃ
সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ’র ব্যাপারে আমাদের দায়িত্ব
১/ সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ’র অধীনে যে সমস্ত অঞ্চল ছিল, (বাংলাদেশ বাদে, যেমনঃ পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা, বিহার ইত্যাদি) সেই সমস্ত অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে মনোযোগী হওয়া। এই অঞ্চলগুলোর অধিবাসীদের ঈমান ও আকিদা উন্নয়নে সর্বাধিক জোর দেয়া।
২/ সেই সমস্ত অঞ্চলে ইসলামী স্থাপত্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়নে সহায়তা করা।
৩/ সেই সমস্ত অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিমদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে বাংলাদেশী মুসলিমদের অবহিত করা। তাদের দারিদ্র বিমোচনে সহায়তা করা।
৪/ সেই সমস্ত অঞ্চলের মুসলিম জনসাধারণের সাথে যেন বাংলাদেশী মুসলিম জনসাধারণের যোগসূত্র স্থাপিত হয় তার জন্য কাজ করা।
৫/ তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে এমন বিপদ হতে তাদের রক্ষা করা। তাদের অভিভাবকত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়া।
৬/ তারা যদি বিপদে পড়ে আশ্রয় নেয় তাহলে তাদেরকে আশ্রয় দেয়া এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য যথাযোগ্য চেষ্টা করা।
বাঙ্গালী সালতানাত এর উত্তরসূরি হিসেবে এগুলো বাংলাদেশী মুসলিমদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। একে তো উম্মাহ হিসেবে দায়িত্ব রয়েছেই, তার উপর যোগ হয়েছে আবার ঐতিহাসিক দায়িত্ব। গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা হতে আসামের এন আর সি’র শিকার মুসলিম সবাই বাঙ্গালী সালতানাতের লিগ্যাসি।
এরা বাঙ্গালী সালতানাতের তৈরি করা বাগানের অংশ। বাগানের উত্তরসূরি হিসেবে এদের কষ্টে ব্যাথিত হওয়া, এদের রক্ষা করা এবং প্রয়োজনে এদের জন্য জীবন দেয়া আমাদের কর্তব্য; এটি কোন ইহসান নয় বরঞ্চ এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের জাতীয় মর্যাদা। এটা আমাদের সৌভাগ্য যে আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে এই মর্যাদার অধিকারী করেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা একটি জাতিকে যে দায়িত্ব দেন তা যদি সেই জাতি যথাযথভাবে পালন করে, তাহলেই তারা দুনিয়ার বুকে মহান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বলকান, ককেশাস কিংবা মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলিমদের রক্ষা করা যেমন তুরস্কের ঐতিহাসিক দায়িত্ব, অর্থোডক্স খৃষ্টানদের রক্ষা করা, সেন্ট্রাল এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত রাশিয়ানদের রক্ষা করা যেমন রাশিয়ার ইতিহাসসূত্রে প্রাপ্ত দায়িত্ব, তেমনি বাংলা, আসাম, উড়িষ্যা, বিহার, ত্রিপুরা, আরাকান ইত্যাদি অঞ্চলের মুসলিমরা আমাদের গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ, তাই এদের রক্ষা করা আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য।
কিন্তু, ইতিহাসের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই দায়িত্বগুলোর ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কি? আমরা কি যথাযথভাবে তা পালন করতে পেরেছি? নাকের ডগাতেই আসামের নেলিতে গণহত্যা (Nellie massacre, February 18, 1983) হয়ে গেল মুসলিমদের; ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, কয়জন জানি আমরা এর ব্যাপারে?
চোখের সামনেই রোহিঙ্গাদের কচুকাটা করা হল, মা-বোনদের গণধর্ষণ করা হল, শিশুদের জ্বলন্ত আগুনে ছুড়ে ফেলা হল, এর প্রতিরোধে আমরা কি করেছি? আসামে এন আর সি’র নামে বাঙ্গালী মুসলিমদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ভরা হচ্ছে, আমাদের অবস্থান কি এই বিষয়ে?
আসামের ব্যাপারে নেই কোন ভ্রূক্ষেপ, আর রোহিঙ্গাদের করছি ঘৃণা, তাদের নিয়ে করছি ট্রল। আসামের মুসলিমদের দুর্দশাকে বলা হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, আর রোহিঙ্গাদের নিয়ে সাগরে পিংপং বলের মত খেলা হচ্ছে। কি দুঃখ! অথচ, এরা বাংলার সুলতানদের রোপণ করা সেই সব মহীরুহ বৃক্ষ যাদের আজ উপড়ে ফেলা হচ্ছে অথবা ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে, এরা আমাদের ভাই, আমাদেরই গৌরবান্বিত ইতিহাসের অংশ। বাগানের মালিক হয়ে কি আমরা এগুলো থামাতে কিছুই করব না, তাদের রক্ষায় নিজেদের জান-মাল কোরবান করব না? মুশরিকদের তৈরি মুসলিম নির্মূলের লেলিহান এই আগুন না থামালে তা আমাদের ঘরেও এসে পৌছবে একদিন।
সুতরাং, হে বাংলাদেশী মুসলিমরা, এটাই তোমাদের ইতিহাসের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া দায়িত্ব। তুমি কি জালিমদের হাত থেকে তোমার ভাই-বোনদের রক্ষা করতে সংগ্রাম করবে না? তারা তোমার পথ চেয়ে আছে। তুমি তাদের জন্য জান বাজী রেখে লড়বে এটা তাদের অধিকার, ইতিহাসসূত্রে পাওয়া অধিকার। তুমি তাদের জন্য লড়বে যেমনটা লড়েছিল শায়েস্তা খাঁ, যেমনটা লড়েছিল আলীবর্দি খাঁ।
চোখের সামনে এগুলো হতেই দেখবে নাকি নিজেদের গৌরবময় অতীতকে আঁকড়ে ধরবে, সংগ্রাম ও সংঘাতের অতীত। ইতিহাসের রেখে যাওয়া দায়িত্বগুলো থেকে পালিয়ে বেড়াবে তুমি নাকি দায়িত্ব গ্রহণ করবে তাওহীদের আদর্শে উজ্জীবিত উত্তমপুরুষের মত? বুকে কি ধারণ করবে সেই মহান সময়ের ঐতিহ্য? অতএব, হে বাংলাদেশী মুসলিম, তোমার সামনে তোমার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব নিয়ে, এখন সিদ্ধান্ত তোমারঃ
তাওহীদের পতাকা খামচে ধরে জালিমের দুর্গ গুড়িয়ে দিবে, ছিনিয়ে আনবে অন্তরের প্রশান্তি?
নাকি
ঘরে চুড়ি পড়ে তোমার পালা আসার জন্য অপেক্ষা করবে?
তথ্যসূত্র:
১ এবং ২/ Burg, Steven L.; Shoup, Paul S. (1999). The War in Bosnia-Herzegovina: Ethnic Conflict and International Intervention; P. 307.
৩/ Hunter, Shireen T. (2016). God on Our Side: Religion in International Affairs. Rowman & Littlefield Publishers; P. 164.
৪ এবং ৫/ Hunter, Shireen T. (2016). God on Our Side: Religion in International Affairs. Rowman & Littlefield Publishers; P. 162.
৬/ Dannreuther, Roland (2001). "Perceptions in the Middle East". In Buckley, Mary; Cummings, Sally (eds.). Kosovo: Perceptions of War and Its Aftermath. London: A&C Black; P. 206–218.
৭/ Deliso, Christopher (2007). The Coming Balkan Caliphate: The Threat of Radical Islam to Europe and the West.
৮/ Bishku, Michael (2013). "Albania and the Middle East". Mediterranean Quarterly; P. 98.
৯/ Mosque destroyed during Bosnian War to be rebuilt with Turkish initiative; Daily Sabah; Istanbul; April 20, 2017.
১০/ Turkey builds biggest mosque of Balkans in Albania; Anadolu Agency; Ankara; January 18, 2019.
১১/ Turkey’s religious diplomacy: Mosqued objectives; Turkey is sponsoring Islam abroad to extend its prestige and power; The Economist; Tirana; January 21, 2016.
১২/ Turkey can become an actor in the new Great Game in Eastern Mediterranean and the Middle East; Euro News; January 17, 2020.
১৩/ Ukrainian president: Putin wants to rebuild Russian Empire; Politico; November 29; 2018.
১৪/ Russian President Vladimir Putin proposes to enshrine God, heterosexual marriage in constitution; The Economic Times; March 03, 2020.
১৫/ Defender of the Faith? Russia's 'Holy War' in Syria; Tony Blair Institute for Global Change; October 14, 2015.
১৬/ Putin Vows to Rebuild Christian Syria, Restoring Churches and Bringing Refugees Home; Newsweek; May 12, 2017.