ইসলামিক ইতিহাসের গল্প | "আলমুত "অত্যন্ত দুর্ভেদ্য এক ঐতিহাসিক গগনচুম্বী কেল্লা এবং আইন জালুতের যুদ্ধ।

ইসলামিক ইতিহাসের গল্প | "আলমুত "অত্যন্ত দুর্ভেদ্য এক ঐতিহাসিক গগনচুম্বী কেল্লা। গুপ্তঘাতক হাশিশিদের ইতিহাস ও আইন জালুতের যুদ্ধ।




আলমুত। অত্যন্ত দুর্ভেদ্য এক ঐতিহাসিক গগনচুম্বী কেল্লার নাম।

এই নামটি দুটো শব্দ দ্বারা গঠিত। আল আর মুত। প্রাচীন পাহলবিভাষায় এর অর্থ চিলের বাসা। 

ইরানের রুদবার প্রদেশে, কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণদিকে, রাজধানী তেহরান থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে, দায়লাম পাহাড়ে, আজও এর ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান।

 এর অবকাঠামো ধ্বংস হলে কী হবে, এর কুখ্যাত অবদান তো আর ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি!

খ্রিষ্টীয় ৮৪০ সালে কেল্লাটি তৈরি করা হয়। ২, ১০০ মিটার উপরে, পাহাড়ের উঁচু চূড়ায়। কেল্লার পথ ছিল মাত্র একটি। তা-ও পাথরিয়া ও আঁকাবাঁকা। 

পথটি পাহাড়ের শীর্ষদেশ থেকে নিচের ঢালুতে নেমে এসেছে। অপরিচিত কারও জন্য সে পথ ছিল বিপদসংকুল। 

যার কারণে কেল্লাটি ছিল অজেয়। কেল্লায় হামলা করার আগে যেকোনো যোদ্ধাকে সাতবার ভাবতে হত।

ভয়ানক এই কেল্লার মূল নির্মাতা কে- জানা যায় না। তবে বলা হয়, প্রাচীন কোনো দায়লামি শাসক এটি নির্মাণ করেছিলেন। 

অত:পর ৮৬০ সালে এটির পুনর্নির্মাণ করেন এক আলাবি শাসক। এর কর্তৃত্ব আলাবিদের হাতেই থাকে। 

১০৯০ সালে ইতিহাসের কুখ্যাত পিশাচগোষ্ঠী ইসমাইলি শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হাশিশিরা এটি দখলে নেয়। 

তাদের নেতা হাসান বিন সাব্বাহ আলাবি শাসককে কেল্লা থেকে বিতাড়িত করে শিয়া বাতিনি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেন।

হাসান বিন সাব্বাহ এই কেল্লাকে বাদশাব শাদ্দাদের বেহেশতের মতো সাজান। কেল্লার ভেতর স্তরে স্তরে সাজিয়ে বিভিন্ন ধরনের চোখ ধাঁধানোকৃষিকর্ম, গাছগাছালি ও বাগবাগিচা করেন। 

বিশেষ করে তিনি কেল্লার নির্জন একটি জায়গায় রঙবেরঙের ফুল, সুস্বাদু ফল ও দৃষ্টিনন্দন উদ্ভিদ রোপণ করেন। 

এগুলোর পাশাপাশি তিনি কৃত্রিমরূপে দুধ, মদ ও মধুর ঝর্ণা তৈরি করেন। এগুলো সামান্য থেমে থেমে ফোয়ারা হয়ে বইত।

 দেখলে যেকেউ মনে করত, এগুলো মাটির তলদেশ থেকে উৎসারিত!

কেল্লায় ছিল আঙুরলতা, চাষ করা মৌচাক। আবার কেল্লার চারিপাশের উর্বর উপত্যকায় চরত হাজার হাজার গবাদিপশু। 

এসবকিছুর দেখাশোনা করার জন্য নিয়োজিত ছিল একদল সুন্দরী ললনার। যারা নৃত্যের তালে তালে নাচগান করত। 

হাশিশিদের এদের প্রেমমদিরায় চুমুক দয়ে অশ্লীলতার রাজ্যে হারিয়ে যেত। পুরো কেল্লার একজন আধ্যাত্মিক গুরুও ছিলেন। 

তিনি হাশিশিদের বলতেন, এটিই হলো জান্নাত!

যেকারও জন্য এই কেল্লায় প্রবেশাধিকার ছিল না। শুধুমাত্র তারাই প্রবেশ করত, যারা হাশিশিদের অন্তর্ভুক্ত হতে চাইত। এদেরকে আধ্যাত্মিক গুরু একজায়গায় জড়ো করতেন। 

এরপর নেশাকর হাশিশ নামক দ্রব্য খাওয়াতেন। খেয়েই এরা নেশায় বুঁদ হয়ে রইত। 

গুরুর ইশারায় এদেরকে বাগানে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। যখন হুঁশ ফিরত, নিজেদেরকে তারা আবিষ্কার করত নয়নাভিরাম বাগানে। 
এ বাগানকেই তারা জান্নাত মনে করতে লাগত!

এখানেই শেষ নয়; আবারও তাদেরকে হাশিশ খাওয়ানো হতো। নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ত তারা। 

যখন জ্ঞান ফির‍ত, তারা নিজেদের আবিষ্কার করত আধ্যাত্মিক গুরুর সামনে। 

তখনই তারা গুরুর চরণে সেজদায় পড়ত লুটিয়ে। গুরু জিজ্ঞেস করতেন, কোত্থেকে এসেছো তোমরা? তারা বলত, জান্নাত থেকে!

এই আলমুত কেল্লা থেকেই হাশিশিনরা মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে রক্তপাত চালাত। 

এখান থেকেই তারা গোপনে হত্যা করে সেলজুক সাম্রাজ্যের উজিরে আজম নিজামুল মুলককে। 

হত্যা করে আব্বাসি খলিফা মুস্তারশিদ বিল্লাহ ও রাশিদ বিল্লাহকে।

 এখানে থেকেই তারা গাজি সালাহুদ্দিন আইয়ুবিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। 

এখান থেকেই তারা ক্রুসেডারদের সাথে আঁতাত করে। 

এই কেল্লাই ছিল তাদের সব পৈশাচিকতার স্বর্গরাজ্য।


এই আলমুত কেল্লার সাথে যে নামটি সবেচেয়ে বেশি জড়িত, সেটি হলো বাগদাদ ধ্বংসের পেছনে পরদার আড়ালের খলনায়ক ইতিহাসখ্যাত শিয়াপণ্ডিত খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি। 

১২৫৬ সালে শিয়াদের নিজারিয়া ইসমাইলিয়া রাজ্যভুক্ত নিশাপুরে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয় মোঙ্গলরা, 

তখন জান নিয়ে পলায়ন করেন তুসি। আশ্রয়গ্রহণ করেন হাশিশিদের এই আলমুত কেল্লায়।

অন্য বর্ণনামতে, হাশিশিরা তাকে ছিনতাই করে নিয়ে বন্দি করে রাখে। আলমুতের কেল্লার বন্দিজীবনেই বেশিরভাগ লেখালেখির কাজ আঞ্জাম দেন বহু প্রতিভাধর এই শিয়া পণ্ডিত। 

এই তুসি একাধারে ছিলেন বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, গাণিতিক ও রাজনৈতিক। বিশ্বজোড়া স্বীকৃত তার গ্রন্থাদি লেখেন এখানেই। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ হলো 'রিসালাতু আখলাকি নাসিরি'।

আলমুত কেল্লাটি ছিল বাগদাদ যাওয়ার পথে। ১২৫৬ সালে মোঙ্গল নেতা হালাকু খাঁ যখন বাগদাদ আক্রমণের উদ্দেশে যাত্রা করেন, তখন হাশিশিদের স্বর্গরাজ্য কুখ্যাত এই কেল্লায় হামলা করেন। 

কেল্লাটি দুর্ভেদ্য থাকা সত্ত্বেও কেল্লার অধিপতি রুকনুদ্দিন খোরশাহ হালাকু খাঁর সাথে সন্ধি করেন। জান ও কেল্লা বাঁচানোর আশায়। 

কিন্তু হালাকু খাঁ কি সেই কিসিমের লোক? কেল্লা দেন গুঁড়িয়ে, কেল্লার সব লোকের গরদানও দেন উড়িয়ে।

আলমুত কেল্লার এই দুর্দিনকালে সেখানে বন্দি ছিলেন তুসি। 

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। তুসির বেলায়ও তা-ই ঘটল। কিন্তু ঝানু রাজনীতিবিদ এই তুসি সাথে সাথে খোলস পালটে নেন।

 তিনি হালাকু খাঁর সাথে হাত মিলান। ওদিকে হালাকু খাঁরও এমন একজন ধুরন্ধর লোকের খুব প্রয়োজন ছিল।

 এর আগে তুসি ছিলেন ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত শিয়া। হাশিশিদের সংস্পর্শে এসে তিনি ইসমাইলি শিয়াতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।

কথায় আছে- চোরে চোরে মাশতুত ভাই। আলমুত কেল্লা থেকেই তুসি গোপন আঁতাত কায়েম করেন আব্বাসি খিলাফতের বিশ্বাসঘাতক শিয়া উজিরে আজম মুহাম্মদ ইবনে আলকামির সাথে।

 চিঠি চালাচালি করে ধ্বংসের পুরো নীলনকশা আঁকেন। তার করা ছক অনুযায়ী ১২৫৮ সালে হালাকু খাঁ বাগদাদ ধ্বংস করেন। 

বইয়ে দেন রক্তের বন্যা। এভাবেই কবরস্থ করেন সোনালি সভ্যতার এক সমৃদ্ধ অধ্যায়।

পুনশ্চ : আলমুত কেল্লা ছিল বাগদাদ ধ্বংসের আঁতুড়ঘর। এখান থেকেই অঙ্কিত হয় আক্রমণের নীলনকশা। 

আর সেই নকশা আঁকেন নাসিরুদ্দিন তুসি। এভাবেই তিনি পৃথিবীসীর কাছে শিয়াদের আসল চেহারা উন্মোচিত করে যান।

 যারা তাদের জাতিগত ইতিহাসে সবসময় ইসলামের শত্রুদের সাথে মিলে গোপন পাঁয়তারা এঁটেছে।
________
তথ্যসূত্র : আল-কামিল ফিত তারিখ : ৯/৪৭৯-৫৬১, ইমাম ইবনুল আসির।

Ainul Haque Qasimi



আইন জালুতের যুদ্ধ।

১২৬০ সালের ২৫ শে রমাদান আজকের এই দিনে সংগঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক আইন জালুতের প্রান্তরে ঐতিহাসিক যুদ্ধ। যা রক্ষা করেছিল পুরো মানব সভ্যতাকে। পাল্টে দিয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাস।
হালাগু খানের(চেংগিস খানের নাতি) মোঙ্গল বাহিনী যাদেরকে বলা হত অজেয়। মোঙ্গল নাম শুনতেই অন্তরে কাঁপন ধরে যেত। তারা ছিল হিংস্র, বর্বর, কুৎসিত। তাদের এইবারের লক্ষ্য সর্বশেষ মুসলিম সালতানাত মিশরের মামলুক। মামলুক সুলতান কুতুজ(রহঃ) সিদ্বান্ত নিলেন এইবার এর একটা বিহীত করতেই হবে। তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাঠালেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ জেনারেল দ্যা প্যন্থার খ্যাত রুকনুদ্দিন বাইবার্স (রহঃ)।
সেদিন বাইবার্স (রহঃ) আইন জালুতের প্রান্তরে মোঙ্গল বাহিনীর উপর এতই তীব্র কঠিন আক্রমণ করেছিলেন ময়দানেই মোঙ্গল বাহিনীকে কচুকাটা করেছিলেন। মোঙ্গল যারা ভয়ে পলায়ন করেছিল তাদের পিছু ধাওয়া করে প্রায় ৩০০ মাইল পর্যন্ত গিয়েছিলেন। শত্রু বাহিনীর পিছু ধাওয়া করা, যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘ।
ইনিই সেই বাইবার্স যার হাতে মোঙ্গল বাহিনী স্বয়ং হালাগু খান বারংবার পর্যুদস্ত হয়েছে। বাইবার্স যার নাম শুনলে মোঙ্গলরা যুদ্ধের ময়দান থেকেই পালিয়ে যেত। যার কারনে মোঙ্গলদের বিজয়রথ চিরদিনের জন্য থেমে গিয়েছিল।( বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরা এটাই বিশ্বাস করে। তা না হলে মোঙ্গলরা মিশর ধ্বংস করে উত্তর আফ্রিকা হয়ে স্পেন দিয়ে পুরো ইউরোপকে বিরান করে দিত।
হ্যা, উনিই সেই বাইবার্স যিনি খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। বাইবার্স যার নাম শুনলে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা পরনের কাপড় নষ্ট করার মত অবস্থা হত।
এমনকি খ্রিস্টান ক্রুসেডার ও মোঙ্গল বাহিনীর মিলিত যৌথ বাহিনীকেও বাইবার্সের হাতে বিধ্বস্ত হতে হয়েছে।
সালাহুদ্দীন আইয়্যুবী (রহঃ) ছিলেন সবার প্রতি নরম আর বাইবার্স ছিলেন তার ব্যতিক্রম। ইউরোপীয়রা সালাহুদ্দীন আইয়্যুবী (রহঃ) কে যতটা হাইলাইট করে ততটাই বাইবার্সকে ঘৃণা করে। কারন বাইবার্স ছিলেন কুফফারদের উপর কঠোর আর মুসলিমদের উপর নরম। আর এই কারনের ইউরোপিয়ানরা বাইবার্সের নাম শুনলেই নাক সিটকায়।
ইসলামে সালহুদ্দীন আইয়্যুবীর (রহঃ) এর মত নরমদীল শাসক যেমন দরকার ঠিক তেমনি দরকার বাইবার্স (রহঃ) এর মত কঠিন শাসক।
আইন জালুতের প্রান্তরে অংশগ্রহণকারী সবাইকে আল্লাহ জান্নাতী হিসেবে কবুল করে নিন।
- Spark Sohel Rana
Next Post Previous Post