ইসলামিক উপদেশ মূলক মোটিভেশনাল লেখা - সূরা ইউসুফ থেকে পাওয়া ১২টি জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা
ইসলামিক উপদেশ মূলক মোটিভেশনাল লেখা ২০২২
2.আপনার লক্ষ্যকে ভিজুয়ালাইজ করুন (Visualize your goal)
3.অসাধারণ তাওয়াক্কুল রাখুন (Have extraordinary faith)
4.সঠিক বিষয়ে ফোকাস করুন (Focus on the right thing)
5.গুরুত্বের ক্রমানুসারে কাজ করুন (Prioritize your tasks)
6.তাড়াহুড়া করবেন না (Do not hasten)
7.গাজর ও লাঠিকে মনে রাখুন (Remember the carrot and the stick)
8.এক ভুল দুই বার করবেন না (Don’t repeat your mistake)
9.চুপ হয়ে থাকা শিখুন (Learn to be quiet)
10.সম্পর্ক তৈরী করুন (Connect!)
11.ক্ষমা একটি শিল্প, একে শিখুন (Learn the art of forgiveness)
12.সফলতার সংজ্ঞা জানুন (Know the definition of success)
সূরা ইউসুফ থেকে পাওয়া ১২টি জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা
এক – প্রভাবশালী কুরাইশ নেতা, চাচা আবু তালিবের মৃত্যু তাঁকে রাজনৈতিকভাবে অসহায় করে তোলে; দুই – প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা(রা)-এর মৃত্যু তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে; তিন – তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে যেয়ে তাঁর উপর চরম মানসিক ও শারীরিক লাঞ্ছনা নেমে আসে, যা ছিল নবীজী(সা)-এর জীবনের সর্বনিকৃষ্ট দিন। রাসূলুল্লাহ(সা)-এর এই দুর্দশার সময়ে তাঁকে অনুপ্রেরণা দিতে আল্লাহ সূরা ইউসুফ নাজিল করলেন। সূরা ইউসুফ রাসূলুল্লাহ(সা)-কে এতটাই উজ্জীবিত করেছিল যে, এই সূরা নাজিলের প্রায় দশ বছর পর মক্কা বিজয়ের দিনেও রাসূলুল্লাহ(সা) এই সূরা থেকে আয়াত উদ্ধৃত করেছিলেন।
শিক্ষা ১: অসাধারণ লক্ষ্য স্থির করুন (Set extraordinary goals)
সাধারণ নয়, অসাধারণ লক্ষ্য স্থির করতে হবে। অসাধারণ লক্ষ্য কাকে বলে? অসাধারণ লক্ষ্য হলো এমন একটি ভালো লক্ষ্য যা আমাদেরকে আমাদের সাধ্যের শেষ সীমায় নিয়ে যাবে, নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করবে। প্রতিটা মানুষের অসাধারণ লক্ষ্য নির্ভর করে তার বর্তমান অবস্থার উপর। যেমন, আপনি যদি বেনামাজী হন তাহলে আপনার জন্য অসাধারণ লক্ষ্য হতে পারে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া। আবার, আপনি যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী হন তাহলে আপনার জন্য অসাধারণ লক্ষ্য হতে পারে নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা। একটি অসাধারণ লক্ষ্য অর্জন করার পর সেটা সাধারণ হয়ে যায়, এরপর নতুন অসাধারণ লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়।
অসাধারণ লক্ষ্য কেন স্থির করতে হবে? কারণ, একমাত্র অসাধারণই আমাদের মধ্যে প্যাশন সৃষ্টি করে। অসাধারণের বৈশিষ্ট্যই হলো মানুষকে অনুপ্রাণিত করা। আমাদের প্রিয় লেখক অসাধারণ লেখকেরা। আমাদের প্রিয় খেলোয়াড় অসাধারণ খেলোয়াড়েরা। আমাদের প্রিয় বেড়ানোর জায়গা অসাধারণ সুন্দর জায়গাগুলো।
সূরা ইউসুফের প্রথমেই আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন অসাধারণ এক কাহিনী পড়তে যাচ্ছো তুমি। শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ূন আহমেদ – সবার গল্পগুলোই এই কাহিনীর কাছে নগণ্য। কারন, আমি যে কাহিনী বলতে যাচ্ছি তা সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনী।
শুধুমাত্র জীবনের বড় বড় লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই নয়, যখন যে ভালো কাজটিই আমরা করবো, আমরা সে কাজের জন্য সর্বোচ্চ লক্ষ্য স্থির করবো। যখন কথা বলব সবচেয়ে সুন্দর ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করব। যখন চিন্তা করব গভীর মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করব। এমনকি যখন একটা ইমেইল লিখব – চেষ্টা করব অসাধারন সুন্দর ভাষায় তা লিখতে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ কিছু করার জন্য।
যদি আমরা নিজের দিকে লক্ষ্য করে কখনো দেখি কোনো ভাল কাজে আমরা মিডিয়াম বা গুড লেভেলের লক্ষ্য স্থির করেছি, বুঝে নিতে হবে আমরা শয়তানের ফাঁদে পড়ে গেছি! কারণ, আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন সবচাইতে ভালো (best) কাজগুলো করার জন্য, আর শয়তান চায় আমরা যেন সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হই । আজ থেকেই আসুন শুরু করি শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই। প্রতি দশ মিনিট পরপর নিজেকে প্রশ্ন করি – আমি এখন যে কাজটি করছি তা কি আমি অসাধারণ সুন্দরভাবে করছি?
শিক্ষা ২: আপনার লক্ষ্যকে মনশ্চক্ষুতে কল্পনা করুন (Visualise your goals)
মনের চোখ দিয়ে আপনার লক্ষ্যকে এমনভাবে দেখার চেষ্টা করুন যেন আপনি ইতিমধ্যে তা অর্জন করে ফেলেছেন। আপনি আপনার লক্ষ্যকে যত স্পষ্ট ভিজুয়ালাইজ করতে পারবেন, তত বেশী আগ্রহ অনুভব করবেন লক্ষ্য অর্জনে কাজ করার জন্য। ভেবে দেখুন লক্ষ্যটি অর্জনের পর আপনার মধ্যে কেমন আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে, কতটা গর্বিত বোধ করছেন আপনি, নিজের জীবনটাকে কেমন ধন্য মনে হচ্ছে! শুধু বড় বড় লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই নয়, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন ছোট কাজ যেমন ক্লাসের সবার সামনে প্রেজেন্টেশন দেয়ার আগে, বা বসের সাথে জরুরী কোনো কথা বলার আগে ভিজুয়ালাইজ করে নিন আপনি কী বলতে চান, কীভাবে বলতে চান – এটা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে।
ইউসুফ(আ)-এর বাল্যকালেই আল্লাহ তাঁকে স্বপ্নের মাধ্যমে দেখিয়ে দিলেন তাঁর ভবিষ্যত। জানিয়ে দিলেন, তাঁর অবস্থান হবে তাঁর বাবা নবী ইয়াকুব(আ), তাঁর মা এবং তাঁর বাকী ১১ ভাইয়ের চেয়ে উপরে। এই স্বপ্ন নি:সন্দেহে সারাজীবন ইউসুফ(আ)-কে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
*এই সিজদা ছিল সম্মান প্রদর্শনের সিজদা, ইবাদতের সিজদা নয়। আগের নবীদের শরীআয় সম্মানের জন্য সিজদা করা বৈধ ছিল।
আপনার লক্ষ্য যদি হয় এখন থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো পড়া, তাহলে ভিজুয়ালাইজ করুন কেয়ামতের দিনের কথা যখন আপনাকে কবর থেকে উঠানো হবে। সূর্য ঠিক মাথার উপরে, চারিদিকে কোটি কোটি মানুষের হুড়াহুড়ি-কান্নাকাটি। এখুনি আপনার বিচার শুরু হবে, ভেবে দেখুন তখন আপনার কেমন লাগবে যখন আপনি আল্লাহর সামনে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের আমলনামা নিয়ে দাড়াবেন!
শিক্ষা ৩: দৃঢ় তাওয়াক্কুল রাখুন (Have extraordinary faith)
তাওয়াক্কুল শব্দের অর্থ হলো ‘এটা হবেই’ — এই বিশ্বাস নিয়ে সেই অনুযায়ী কাজ করা। যেমন, আপনি বিশ্বাস রাখেন যে আজ রাতে আপনি মারা যাবেন না এবং আগামীকাল অফিসে যেতে পারবেন। কিন্তু আপনি কি শুধু এই বিশ্বাস নিয়ে বসে আছেন? না, আপনার এই বিশ্বাস এতই দৃঢ় যে আপনি রাতে এলার্ম দিয়ে বিছানায় যান যাতে কাল সকালে সময়মতো ঘুম থেকে উঠতে পারেন – এটাই তাওয়াক্কুল। আমরা যদি আমাদের লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে চাই তাহলে আমাদেরকে তাওয়াক্কুল রাখতে হবে। নিজের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে এই ভেবে যে, যদি আল্লাহ চান তো আমি এটা পারবোই পারবো।
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী তাওয়াক্কুলের অন্যতম উপাদান হলো দু’আ করা। কারণ, ঈমানদার বিশ্বাস করে যে আমি যতই দৃঢ় বিশ্বাস রাখি আর পরিশ্রম করি না কেন, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমার লক্ষ্য অর্জিত হবে না। বড় থেকে ছোট প্রত্যেক কাজে আমাদের পূর্ন বিশ্বাস নিয়ে চেষ্টা করার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে প্রাণ ভরে দু’আ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ(সা) আমাদের বলেছেন, এমনকি জুতার ফিতা ছিড়ে গেলেও যেন আমরা আল্লাহর কাছে দু’আ করি।
আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের অনন্য নজির স্থাপন করেছেন ইউসুফ(আ)-এর বাবা ইয়াকুব(আ)। ইউসুফেরা ছিলেন মোট ১২ ভাই, তার মধ্যে প্রথম ১০ ভাই ছিলেন এক মায়ের সন্তান, আর ছোট দুই ভাই (ইউসুফ ও বিনইয়ামিন) ছিলেন আরেক মায়ের সন্তান। বড় ১০ ভাইয়েরা ছোট ২ ভাইকে প্রচন্ড হিংসা করতো। ইয়াকুব(আ) ভালমতোই জানতেন যে, তার বড় ভাইয়েরা যেকোনো সুযোগ পেলেই ইউসুফের কোনো ক্ষতি করে ফেলবে। তাই তারা যখন ইয়াকুবের(আ) কাছে যেয়ে বললো তারা ইউসুফকে নিয়ে ‘খেলতে’ যাবে, বৃদ্ধ ইয়াকুব(আ) সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন ইউসুফকে তাদের সাথে না দিতে।
সে (ইয়াকুব) বলল, ‘তোমরা তাকে নিয়ে গেলে আমার কষ্ট হবে, আর আমার ভয় হয় তোমরা তার ওপর নজর না দিলে তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলবে’। (১২:১৩)
বড় দশ ভাই তারপরেও অনবরত অনুরোধ করতে থাকলে অগত্যা ইয়াকুব(আ) রাজি হলেন ইউসুফকে তাদের সাথে যেতে দিতে। হিংসার আগুনে জ্বলে তারা ইউসুফকে খেলার নাম করে জংগলে নিয়ে এক পরিত্যক্ত কূপে ফেলে দিল, আর এসে ইয়াকুবকে(আ) বলল যে ছোট্ট ইউসুফকে নেকড়ে খেয়ে ফেলেছে। ইউসুফের রক্তমাখা কাপড় দেখে ইয়াকুবের(আ) বুক কষ্টে ফেটে গিয়েছিলো ঠিকই, তবু তিনি কিন্তু হা-হুতাশ করেননি, চিল্লাপাল্লা করে বাসা মাথায় তোলেননি। বরং, তিনি আল্লাহর উপর পূর্ন আস্থা রাখলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ইউসুফ একদিন নবী হবেই এবং শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবেই। ইয়াকুব(আ) জানেন, আল্লাহ কখনো এমন কিছু করেন না যাতে বান্দার অমঙ্গল হয়। সাময়িক কষ্টগুলোতে ধৈর্য্যের পরীক্ষায় পাশ করলেই আল্লাহ বান্দাকে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি দেন।
আর তারা জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে এনেছিলো। সে (ইয়াকুব) বলল, বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি কাহিনী গড়ে নিয়েছে। সুতরাং আমার পক্ষে পূর্ণ ধৈর্য্যই শ্রেয়। তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল। (১২:১৮)
আমরা প্রত্যেকটা মানুষই আমাদের নিজেদের জন্য একটা সীমাবদ্ধতার দেয়াল তৈরী করে রাখি, তারপর আমরা শুধু ওই দেয়াল ঘেরা জগতের ভেতরেই ঘুরাফেরা করতে পছন্দ করি। মানুষের নিজের তৈরী সীমাবদ্ধতার এই জগতকে বলে ‘কমফোর্ট জোন’। মহান আল্লাহ অনেক সময় আমাদেরকে আমাদের কমফোর্ট জোনের বাইরে ঠেলে দেন, যেন আমরা সীমাবদ্ধতার দেয়াল ভেঙ্গে নিজের উন্নতি করতে পারি।
ইয়াকুব(আ)-এর জীবনে সবচেয়ে প্রিয়পাত্র ছিলেন তাঁর পুত্র ইউসুফ(আ)। কিন্তু, আল্লাহ চাচ্ছিলেন ইয়াকুব(আ) যেন ধৈর্যশীলদের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদা অর্জন করেন, তাই তিনি প্রাণপ্রিয় পুত্র ইউসুফকে তাঁর থেকে আলাদা করে দিলেন। ইয়াকুব যত বেশী ধৈর্য ধরবেন, ততই তাঁর মর্যাদা বাড়তে থাকবে। একইভাবে মহান আল্লাহ অনেক সময় আমাদেরকেও আমাদের কমফোর্ট জোনের বাইরে ঠেলে দেন যাতে আমরা আমাদের মর্যাদা উন্নত করতে পারি। হঠাৎ করে চলে যাওয়া চাকরি আমাদের নতুন স্কিল শিখতে বাধ্য করে, অসুখগুলো আমাদেরকে বাধ্য করে দু’আ করতে, প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদেরও একদিন মরে যেতে হবে।
আমরা যদি অসাধারণ লক্ষ্য অর্জন করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে আমাদের কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি এমন কিছু পেতে চাই যা কখনো পাইনি, তাহলে আমাদের এমন কিছু করতে হবে যা কখনো করিনি। এমনভাবে পরিশ্রম করতে হবে যেভাবে আগে কখনো করিনি। এমনভাবে নামাজে মনোযোগ দিতে হবে যেভাবে আগে কখনো দেইনি। ফজরের নামাজের জন্য ঘুম থেকে ওঠা যতই দু:সাধ্য মনে হোক কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে সেই অসাধ্য সাধনের পেছনেই ছুটতে হবে।
শিক্ষা ৪: সঠিক বিষয়ে ফোকাস করুন (Focus on the right thing)
আপনি আপনার অফিসের টেবিলে কাজ করতে বসেছেন। এই মুহূর্তে আপনি কী নিয়ে চিন্তা করবেন তা সম্পূর্নই আপনার ব্যাপার। আপনি চাইলেই চিন্তা করতে পারেন – গতকাল রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি, শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, সকালে আরেকটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো, ধুর এখন আবার ওই বোরিং ফাইলটা নিয়ে বসতে হবে, এই ফালতু কাজগুলি করে আমার লাভ কী? অন্যদিকে আপনি চাইলেই চিন্তা করতে পারেন – ওয়াও! আজকে আমি ওই প্রবলেমটা নিয়ে চিন্তা করবো? এখানে তো আমার এমন কিছু করার সুযোগ আছে যা আর কেউ কোনোদিন করেনি।
আমি যদি আমার সময় নষ্ট না করে প্রোডাক্টিভ কিছুতে কাজে লাগাই আল্লাহ আমার উপর কতই না খুশী হবেন! আমার কাজ যদি মানুষের জীবনে ভালো কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে তাহলে আল্লাহ অবশ্যই আমাকে অনেক পুরষ্কার দিবেন! লক্ষ্য করে দেখুন, প্রথম ধারার চিন্তাগুলি আপনার মধ্যে কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে ভাব তৈরী করেছিলো, আর দ্বিতীয় ধারার এই চিন্তাগুলো আপনার মধ্যে কেমন প্যাশন তৈরী করছে! যেকোনো পরিস্থিতিতেই আমরা কী অর্জন করবো, ভালো না খারাপ বোধ করবো – তা নির্ভর করে আমরা কিসের উপর ফোকাস করছি তার উপর।
লাইফ স্কিল কোচেরা বলেন যে, ফোকাস করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সময় হলো কাজ শুরুর প্রথম এক ঘণ্টা। যদি প্রথম একঘণ্টায় ফেইসবুক, ই-মেইল, ইউটিউব বা অন্য কোনো ধরণের ডিস্ট্র্যাকশন থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন, তাহলে বাকী সময় ফোকাস করা অনেক সহজ হয়। রাসূলুল্লাহ(সা)ও গুরুত্ব দিয়েছেন ভোরে উঠে কাজের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার প্রতি।দিনের শুরু থেকেই ফোকাস করুন এবং Extraordinary effort দিন।
চরম বিরূপ পরিবেশেও নিজের লক্ষ্যের দিকে কীভাবে ফোকাস করতে হয় তার শিক্ষা আমরা পাই নবী ইউসুফ(আ)-এর কাছ থেকে। কূপ থেকে পানি তুলতে গিয়ে ছোট্ট ইউসুফ(আ)-কে খুঁজে পেল একদল যাযাবর। কানআন (বর্তমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন) এলাকার ছেলে ইউসুফকে তারা নিয়ে বিক্রি করে দিল মিশরের বাজারে। ইউসুফকে কিনে নিল মিশরের অন্যতম প্রভাবশালী এক মন্ত্রী (আযীয)। মন্ত্রীর কোনো সন্তান ছিল না, আর ইউসুফ ছিলেন অকল্পনীয় রকম সুন্দর এক ছেলে। মন্ত্রী তার স্ত্রীকে বললো ইউসুফকে নিজের ছেলের মতোই বড় করতে। এভাবে করে ১০-১৫ বছর কেটে গেল, ইউসুফ হয়ে উঠলেন পৃথিবীর সর্বকালের সবচাইতে হ্যান্ডসাম যুবক।
মন্ত্রী কাজের চাপে সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে, মন্ত্রীর স্ত্রীর খুব একা একা লাগে। দিনে দিনে মন্ত্রীর স্ত্রী চরম আকর্ষণ বোধ করা শুরু করলো ইউসুফের প্রতি। খালি বাসা পেয়ে মন্ত্রীর স্ত্রী ইউসুফকে সিডিউস করা শুরু করলো। দিনের পর দিন ইউসুফকে কাবু করার নিত্যনতুন অপচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলো সে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কয়জন পুরুষ পারতো তার চিন্তা-চেতনা মন্ত্রীর স্ত্রীর দিকে না দিয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দিকে দিতে? ইউসুফ(আ) তাই করেছিলেন।
মন্ত্রীর স্ত্রী দরজা বন্ধ করে তাঁর সাথে চাপাচাপি করলে তিনি দৌড়ে পালিয়ে আসেন। এলাকার তাবত সুন্দরীরা একাট্টা হয়ে ইউসুফকে দেখতে এসে সবাই যখন তাঁর রূপে পাগল হয়ে যায় তখনও ইউসুফ ফোকাস হারাননি। নিজের সহজাত চাহিদা, এক ঝাঁক সুন্দরীর অনুরোধ, মন্ত্রীর স্ত্রীর আদর-আপ্যায়ন – এর কোনো কিছুতেই ইউসুফ লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন না। ইউসুফের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, আর তাই তিনি একাগ্রতার সাথে আল্লাহর কাছে দু’আ করলেন:
ইসলামিক উপদেশ
মনে করুন, আপনার কাছে একটা কাঁচের বয়াম আছে, আর আছে কিছু পাথর, নুড়ি আর বালু; আপনার লক্ষ্য হলো বয়ামে যত বেশী সংখ্যক সম্ভব পাথর ঢুকানো। এখন আপনি যদি প্রথমেই নুড়ি আর বালু দিয়ে আপনার বয়ামটি ভরে ফেলেন তাহলে কিন্তু আর খুব বেশী পাথর ঢুকানোর জায়গা পাবেন না। কিন্তু, আপনি যদি পাথরগুলিকে ঢুকিয়ে নেন তাহলেও নুড়ি আর বালুগুলি ঢুকানোর মতো জায়গা ঠিকই অবশিষ্ট থাকবে।
প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর আরেকটি টিপস হলো আর্জেন্ট-ইম্পর্ট্যান্ট ফর্মূলা [৮]। আর্জেন্ট হলো সেই কাজগুলি যা সম্পন্ন করতে হলে এখুনি করতে হবে, ইম্পর্টেন্ট হলো সেই কাজ যা সম্পন্ন করতে না পারলে ক্ষতি হবে। আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলো চার ভাগে ভাগ করা যায়:
আর্জেন্ট এবং ইম্পর্ট্যান্ট (যেমন – এক দিনের মধ্যে প্রজেক্টের রিপোর্ট দিতে হবে);
আর্জেন্ট কিন্তু ইম্পর্ট্যান্ট না (যেমন – টিভিতে লাইভ খেলা দেখা);
ইম্পর্ট্যান্ট কিন্তু আর্জেন্ট না (যেমন – জগিং করা); এবং
ইম্পর্ট্যান্টও না এবং আর্জেন্টও না (যেমন – মানুষের বদনাম করে বেড়ানো)।
১নং গ্রুপের কাজগুলি আমাদের ভালোমতো সম্পন্ন করতেই হবে, কারণ অন্য কোনো উপায় নেই। ২নং গ্রুপের কাজগুলি কমিয়ে আনতে হবে। ৩নং গ্রুপের কাজগুলিকে জোর করে হলেও করতে হবে (না হলে অচিরেই এটা ১নং গ্রুপের কাজে পরিণত হবে)। মনে রাখবেন, চরমভাবে সফল মানুষেরা ৩নং গ্রুপের কাজগুলো গুরুত্বের সাথে করে বলেই তারা সফল। আর ৪নং গ্রুপের কাজগুলি পুরোপুরি বাদ দিতে হবে।
শিক্ষা ৬: তাড়াহুড়া করবেন না (Do not rush)
আমরা অনেকে মনে করি যে, তাড়াহুড়া করে কাজ করলে বুঝি অনেক বেশী কাজ করা যায়। কিন্তু, সত্য হলো ধীর-স্থিরতার সাথে কাজ করলে আমরা নির্ভুলভাবে কাজ সম্পন্ন করতে পারি, ফলে আমাদের সময় বাঁচে। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন, ‘ধীর-স্থিরতা আসে আল্লাহর তরফ থেকে, আর তাড়াহুড়া আসে শয়তানের তরফ থেকে’ (বায়হাকী)।
মনে করুন, আপনাকে বিনা দোষে সাত বছর ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। তারপর জানতে পারলেন রাষ্ট্রপতি তার বিশেষ ক্ষমতাবলে আপনাকে মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি তখন কী করবেন? নিশ্চয়ই লাফাতে লাফাতে আগে জেল থেকে বের হবেন, তাই না? কিন্তু, ইউসুফ(আ) এরকম তাড়াহুড়া করেননি। রাজার স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারার পুরষ্কার স্বরূপ রাজা যখন ইউসুফ(আ)কে মুক্ত করার নির্দেশ দিলেন তখনও তিনি ধৈর্য ধরেছেন। কারন, এরকম বিশেষ ক্ষমতাবলে মুক্তির প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিলো না। যে অপরাধে তাঁকে বন্দী করা হয়েছিলো তিনি রাজার কাছে তার পুনর্তদন্ত দাবী করলেন। ইউসুফ(আ) আত্মবিশ্বাসী ছিলেন নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এটা প্রমাণিত হবে যে, তিনি মন্ত্রীর স্ত্রীর সাথে জোর-জবরদস্তি করে কিছু করতে চাননি। আর এর ফলে তাঁর মর্যাদা বাড়বে বৈ কমবে না।
রাজা বললো, ‘তোমরা ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এসো’। সুতরাং যখন দূত তার কাছে গেলো সে বললো, ‘তুমি তোমার প্রভুর কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো, যে মহিলারা তাদের হাত কেটে ফেলেছিলো তাদের অবস্থা কি? আমার রব তাদের ছলনা সম্পর্কে ভালো করেই জানেন’। (১২:৫০)
ইউসুফ(আ) নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর রাজা যখন তাঁকে একজন সহচর হিসেবে নিযুক্ত করতে চাইলেন তখনো তিনি তাড়াহুড়া করে সেই পদ গ্রহণ করলেন না। বরং, তিনি কোষাধ্যক্ষ হতে চাইলেন। কারন, মিসর যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে তা ইউসুফের মতো দূরদর্শী শাসক ছাড়া অন্য কারও পক্ষে সামাল দেয়া দু:সাধ্য হয়ে পড়বে।
রাজা বললো, ‘ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তাকে আমার একান্ত সহচর নিযুক্ত করবো’। তারপর রাজা যখন তার সাথে কথা বললো তখন বললো, ‘আজ তুমি আমাদের কাছে মর্যাদাবান ও বিশ্বাসভাজন’। সে বললো, ‘আমাকে দেশের কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করুন। নিশ্চয়ই আমি সুসংরক্ষণকারী, সুবিজ্ঞ’। (১২:৫৪-৫৫)
শিক্ষা ৭: পরিস্থিতি বুঝে কোমল অথবা কঠোর আচরণ করুন (Remember the carrot and the stick)
জন্মের মুহূর্ত থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ তার প্রতিটা কাজই করে হয় গাজর পাওয়ার জন্য অথবা লাঠির বাড়ি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। অন্যভাবে বলতে গেলে, মানুষ সবসময় সেই কাজটিই করে যেই কাজটি করলে তার বেদনার (pain) চেয়ে আনন্দের (pleasure) পরিমাণ বেশী হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভালো ছাত্র পড়াশুনার কষ্ট বেছে নেয়, কারণ তার কাছে এই কষ্টের চেয়ে ভালো চাকরির আনন্দ বেশী গুরুত্বপূর্ন। আবার, খারাপ ছাত্র পড়াশুনায় ফাঁকি মেরে সিনেমা দেখে সময় কাটায়, কারণ তার কাছে ভালো চাকরি না পাওয়ার কষ্টের চেয়ে সিনেমা দেখার আনন্দের মূল্য বেশী। আনন্দ-বেদনার এই সহজাত প্রতিক্রিয়াকে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজে লাগাতে পারি।
যখন কোনো গুরুত্বপূর্ন কাজ করতে আমাদের ভালো লাগবে না তখন আমরা এই কাজে ব্যর্থ হওয়ার কষ্ট এবং সফল হওয়ার আনন্দ নিজেকে মনে করিয়ে দিতে পারি। আবার, আগামী এক ঘন্টায় এই কাজটি শেষ করতে পারলে অমুক খাবারটি খাবো – এই জাতীয় আনন্দদায়ক টোপ দিয়েও নিজেকে কাজে মনোযোগী করে তুলতে পারি।
তারা ভাবলো তাঁর কাছে যেয়ে বিভিন্ন মালপত্রের বিনিময়ে যদি খাবার নিয়ে আসা যায় তাহলে কতই না ভালো হয়। সেই আমলে এক দেশের মানুষ অন্য দেশে আসলে তাদেরকে সবাই সন্দেহের চোখে দেখত। তবু তারা কোষাধ্যক্ষের সুনাম আর নিজেদের নিরুপায় খাদ্যহীন অবস্থা বিবেচনা করে মিসরে আসলো।
ইউসুফ(আ) প্ল্যান করলেন কীভাবে এই দশ ভাইকে বলা যায় বিনইয়ামিনকে তারা যাতে পরের বার অবশ্যই নিয়ে আসে। আর এই প্ল্যানে তিনি ব্যবহার করলেন গাজর এবং লাঠি। ইউসুফ(আ) তাদেরকে এই বলে লোভ দেখালেন, দেখো তোমরা যদি তোমাদের সৎ ভাইকেও নিয়ে আসো তাহলে কিন্তু আরো বেশী শস্য পাবে (কারণ, মাথা গুনে শস্যের হিসাব করা হচ্ছিল)। আর ভয় দেখালেন এই বলে – যদি ওই ভাইকে তোমরা পরের বার নিয়ে আসতে না পারো তাহলে এটা প্রমাণিত হবে যে তোমরা বেশী শস্য আদায় করার জন্য ঐ ভাইয়ের কথা বানিয়ে বলছিলে, ফলে তোমাদেরকে আর শস্য দেয়া হবে না।
আর সে (ইউসুফ) যখন ওদের রসদের ব্যবস্থা করে দিল তখন সে বলল, ‘তোমরা আমার কাছে তোমাদের সৎ ভাইকে নিয়ে এসো। তোমরা কি দেখছ না যে আমি পুরো মাপ দেই? আর আমি অতিথির সেবা ভালোই করি? কিন্তু তোমরা যদি তাকে আমার কাছে না নিয়ে আস তবে আমার কাছে তোমাদের জন্য কোনো রসদ থাকবে না, আর তোমরাও আমার কাছে আসবে না। (১২:৫৯-৬০)
আমরা যদি আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে, আমরা একই ভুল বারবার করতে থাকি। শুধু তাই না, একই ভুল বারবার করে আমরা ভিন্ন ফলাফলেরও আশা রাখি! চিন্তা করে দেখুন, আপনার বসের সাথে কথা বলতে গিয়ে একই ভুল অ্যাপ্রোচ একাধিক মিটিং-এ প্রয়োগ করেছেন কিনা, আপনি যে ডকুমেন্ট লিখেন তাতে একই বানানে বারবার কনফিউজড হয়ে যান কিনা? একই ভুল বারবার করলে আপনি খুব সম্ভবত একই রেজাল্ট পাবেন, ভালো কিছু পাবেন না।
ইউসুফ(আ)এর ভাইয়েরা মিসর থেকে ফিরে এসে তাদের বাবা ইয়াকুব(আ)কে বললো তারা বিনইয়ামিনকে মিসরে নিয়ে যেতে চায়। কারণ, বিনইয়ামিনকে নিয়ে না গেলে মিসরের কোষাধ্যক্ষ আর শস্য দিবেন না। ইয়াকুব(আ) জবাবে বললেন – তোমরা কি মনে করো ইউসুফকে তোমাদের সাথে দিয়ে আমি যে ভুল করেছিলাম সেই ভুল আমি বিনইয়ামিনের ক্ষেত্রেও করবো?
সে বললো, ‘আমি কি ওর ব্যাপারে তোমাদেরকে এমনই বিশ্বাস করবো যেমন ওর ভাইয়ের ব্যাপারে এর পূর্বে আমি তোমাদেরকে বিশ্বাস করেছিলাম’? … (১২:৬৪)
ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ। ইসলামী পরিভাষায় একে বলে তাওবা (ফিরে আসা)। জীবনে সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি হলো তাওবা। কারণ, তাওবাকারী তার তাওবার মাধ্যমে প্রমাণ করে যে, সে নিজের পরিবর্তন চায়, উন্নতি চায়। তাওবা পানি ঢেলে দেয় অহংকার আর গোয়ার্তুমির আগুনে। একটি পরিপূর্ন তাওবার বৈশিষ্ট্য হলো:
ভুল কাজটি দ্রুত ছেড়ে দেয়া;
অনুশোচনা বোধ করা;
ভুলটির পুনরাবৃত্তি না করা; এবং
এই ভুলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে তাকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া।
আমরা যখন আমাদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবো তখন আমাদের প্ল্যানগুলি ফ্লেক্সিবল হবে। যদি প্ল্যান ‘এ’ কাজ না করে তাহলে আমরা প্ল্যান ‘বি’ তে চলে যাবো। যদিও খুব সহজে লক্ষ্যের পরিবর্তন করা ঠিক নয়, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনের যে প্ল্যান তা প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা পরিবর্তন করতে পারি।
- ইসলামিক উপদেশ মূলক বাণী
- ইসলামিক উপদেশ বাণী
- সেরা ইসলামিক উক্তি
- ইসলামিক উপদেশ মূলক গল্প
- ইসলামিক প্রবাদ বাক্য
- ইসলামিক বানী চিরন্তনী
- ইসলামিক জীবনের উক্তি
- ইসলামের বাণী সমূহ
মোটিভেশনাল লেখা
শিক্ষা ৯: চুপ হয়ে থাকা শিখুন (Learn to be quiet)
ভেবে দেখুন তো এরকম কিছু আপনার জীবনে ঘটেছে কিনা – আপনি ফেইসবুকে আপনার মতামত জানিয়ে নিজের টাইমলাইনে কিছু লিখেছেন। সাথে সাথেই আপনার সাথে অমত পোষণ করে একজন ঝাঁপিয়ে পড়লো আপনার উপর। আপনি উত্তর দিলেন, তো সে আপনাকে আরো খেপিয়ে দিয়ে কিছু লিখলো, আপনি আবার উত্তর দিলেন, সে আরো বেশী খেপিয়ে দিয়ে মন্তব্য করলো।
ফেইসবুকের এক সামান্য স্ট্যাটাস মেসেজ নিয়ে মহাবিরক্তিতে দিন কাটা শুরু হলো আপনার। কোনো কাজেই মনোযোগ দিতে পারছেন না, ঘুরেফিরে তীর্যক কথাগুলো আপনার মনের দেয়ালে শুধু ধাক্কা দিতে থাকলো। কী করবেন এরকম পরিস্থিতিতে? এর ইসলামিক উত্তর খুব সহজ – মানুষটির মঙ্গল কামনা করে কেটে পড়ুন। [দেখুন: কোরআন ২৫:৬৩ এবং ২৮:৫৫]
তল্লাশী করতে করতে সেই কাপ পাওয়া গেলো বিনইয়ামিনের ব্যাগে (উল্লেখ্য, ইসলাম মিথ্যা বলা ও ওয়াদা ভংগের অনুমতি দেয় না, কিন্তু বড় কোনো ক্ষতি এড়ানোর জন্য ট্রিক করা ইসলাম সমর্থন করে)[১]। চুরির আইন অনুসারে ইউসুফ(আ) বিনইয়ামিনকে তাঁর কাছে রেখে দিলেন । বিনইয়ামিনের বিরুদ্ধে যখন চুরির বিচার চলছে তখন তাকে রক্ষা না করে দশ সৎ ভাই বরং এটা প্রমাণ করতে লেগে গেল যে তারা বিনইয়ামিনের এর মতো চোর নয়। তারা দশ ভাই যে মায়ের সন্তান তারা সবাই খুব ভালো। অন্যদিকে, বিনইয়ামিন ও তার হারিয়ে যাওয়া ভাই ইউসুফ(আ) অন্য মায়ের সন্তান। তারা ইউসুফ(আ)-এর ছোটবেলার একটা ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে বলল যে বিনইয়ামিনের ভাই ইউসুফও চুরি করেছিলো, কাজেই বিনইয়ামিনও যে চুরি করবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। চোখের সামনে নিজের ব্যাপারে এরকম ডাহা মিথ্যা শুনেও ইউসুফ(আ) কোনো জবাব দিলেন না, শুধু মনে মনে তাদের এই কথাকে ঘৃণা করলেন।
রাগ-নিয়ন্ত্রণ:
আমরা যেসব মুভি-নাটক দেখি, বই পড়ি – এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের শেখায় রাগ করতে পারাটা হলো ‘গাটস’-এর ব্যাপার, যে রাগ করতে না পারে তার কোনো পার্সোনালিটি নেই। আর ইসলাম বলে ঠিক উল্টো কথা – যে রেগে যায় তার কোনো পার্সোনালিটি নেই। কারণ, রেগে যাওয়া মানুষ তার নিজের নিয়ন্ত্রণ শয়তানের হাতে সমর্পণ করে। আপনি যা করেননি তার জন্য কেউ হয়তো আপনাকে দোষ দিচ্ছে, বা আপনি যে কাজ অপছন্দ করেন ইচ্ছে করে সেই কাজই সে বার বার করে যাচ্ছে, অথবা অন্যদের কাছে আপনার বদনাম করে বেড়াচ্ছে – এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে আমাদের করণীয় কি? কোরআন ও সুন্নাহ থেকে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা জানতে পারি:
নিজের কন্ঠকে গাধার মধ্যে উচ্চ না করে বরং নামিয়ে ফেলুন [দেখুন: কোরআন ৩১:১৯]
যে আপনাকে রাগিয়েছে তাকে ক্ষমা করে দিন [দেখুন: কোরআন ৪২:৩৭]
ধৈর্য ধরুন এবং সৌজন্য সহকারে এড়িয়ে চলুন [দেখুন: কোরআন ৭৩:১০]
তার দোষের কথা ভুলে গিয়ে গুণের কথা মনে করুন [সহিহ মুসলিম]
রাগ আসে শয়তানের তরফ থেকে। সুতরাং, ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’ বলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান। [৫]
আমরা রেগে গেলে শয়তান দ্রুত বেগে আমাদের রক্তে ছুটাছুটি করে আমাদের আরো রাগিয়ে দেয়। আগুনের তৈরী শয়তানকে জব্দ করার জন্য তাই অজু করুন। [৫]
দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পড়ুন, বসে থাকলে শুয়ে পড়ুন। সোজা কথা, এক্কেবারে ইন্যাক্টিভ হয়ে যান। নচেৎ রাগের মাথায় আপনি হয়তো এমন কিছু বলে ফেলবেন বা করে ফেলবেন যার জন্য সারাজীবন আফসোস করতে হবে। [৫]
আপনার ধৈর্যের জন্য আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশা রাখুন।
মনে রাখবেন, আপনার সাথে যে ভালো ব্যবহার করে তার সাথে ভালো ব্যবহার করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, কৃতিত্ব হলো যে খারাপ ব্যবহার করে তার সাথে ভালো ব্যবহারে।
শিক্ষা ১০: সম্পর্ক তৈরী করুন (Connect!)
কাজ শেষে বাসায় ফিরে কম্পিউটার, মোবাইল আর টিভিতে বুঁদ হয়ে না থেকে মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করুন। আল্লাহর পরেই আমাদের উপর সবচাইতে বেশী অধিকার আমাদের বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান-সন্তুতির – বাসায় ফিরে তাদেরকে সময় দিন। ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশীদের – বাসায় গিয়ে, ফোন করে, ইমেইল করে, যেভাবেই পারুন যোগাযোগ রক্ষা করুন, যে আপনার সাথে যোগাযোগ রাখে না তার সাথে আরো বেশী করে যোগাযোগ করুন।
কোথাও গেলে মটকা মেরে বসে না থেকে আমাদের অন্য মানুষদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে হবে। মহান আল্লাহ একেক মানুষকে একেক রকম শারীরিক গঠন, চিন্তা-ভাবনা, দক্ষতা দিয়ে তৈরী করেছেন যাতে আমরা একে অন্যকে জানার জন্য প্রয়োজনীয়তা বোধ করি [দেখুন: কোরআন ৪৯:১৩]।
সবসময় মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে হবে। ইউসুফ(আ)-এর জীবনের পিছনের একটা ঘটনা থেকে আমরা মানুষকে সাহায্য করার আদব শিখতে পারি। ইউসুফ (আ) যখন জেলে ছিলেন তখন তাঁর কাছে রাজার দূত রাজার দেখা স্বপ্নের অর্থ জানতে চেয়েছিলো। উত্তরে ইউসুফ(আ) শুধু স্বপ্নের অর্থ বলেই ক্ষান্ত হননি, বরং নিজ উদ্যোগে বলে দিয়েছিলেন আসন্ন দুর্ভিক্ষ থেকে মিসর রাজ্যকে বাঁচাতে চাইলে রাজার করণীয় কী।
অথচ, এই সেই দূত যে অনেক বছর আগে ইউসুফ(আ)-কে কথা দিয়েছিলো সে রাজার কাছে গিয়ে এটা বলবে যে ইউসুফ বিনা দোষে জেলে বন্দী আছে। এরকম অকৃতজ্ঞ বন্ধু যদি আমাদের কাছে সাহায্য চাইতো তাহলে আমরা কি তাকে সাহায্য করতাম? ইউসুফ(আ) কিন্তু একবারও সেই অকৃতজ্ঞতার কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন না, বরং সে যা সাহায্য চেয়েছিলো তার চেয়ে বেশী সাহায্য করলেন।
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সাহায্য করা
কেউ কৃতজ্ঞতা জানাক আর না-ই জানাক তবু তাকে সাহায্য করা
নিজ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া
সাহায্যপ্রার্থী যতটুকু চাচ্ছে তার চেয়ে বেশী দিয়ে সাহায্য করা
নিজেকে সুপিরিয়র মনে না করে সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়া
‘আমি সাহায্য না করলে তুমি এটা পারতে না’ – এই জাতীয় ভাব না নেয়া
একইভাবে, কোনো সমস্যায় পড়লে সুন্দর কথার মাধ্যমে মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে হবে। অনেক সময় আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা একটা কিছু বুঝার চেষ্টা করে হয়তো পারি না, কিন্তু আমার পাশের চেয়ারে বসা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলে সে এক মিনিটেই আমাকে এটা বুঝিয়ে দিতে পারতো। আমি পারি না বলার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই, সাহায্য চাওয়ার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই – যদি এই সাহায্য চাওয়ার উদ্দেশ্য হয় নিজেকে ইম্প্রুভ করা।
যার সাহায্য চাইছেন তাকে সম্মানের সাথে সম্বোধন করা
নিজের করুন অবস্থা স্বীকার করে নেয়া
সাহায্যকারীর প্রশংসা করা
সাহায্যকারীর মঙ্গল কামনা করা
এই চারটি কন্ডিশন মেনে আমরা যদি কারো সাহায্য চাই, আল্লাহ চাইলে আমরা সাহায্য পাবোই।
শিক্ষা ১১: ক্ষমা একটি শিল্প, একে শিখুন (Learn the art of forgiveness)
ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করা – এই দুইটি কাজই মানুষ হিসাবে আমাদেরকে মর্যাদাকে উন্নত করে। আমরা যদি ক্ষমার শিল্পকে আয়ত্ত না করতে পারি তাহলে আমাদের মনের মধ্যে বাসা বাঁধবে ঘৃণা আর অহংকার। এটি শিখতে না পারলে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, ভয়াবহ কঠিন হবে পরকালের হিসাব।
এই আয়াতে মহান আল্লাহ আমাদের শেখালেন-
‘আমি অমুক কারণে ওই কাজটা করেছিলাম’ জাতীয় একটা শব্দও না বলা
ক্ষমাকারীর প্রশংসা করা
অনুশোচনা সহ নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়া
পরবর্তীতে আপনার বাবা-মা, স্বামী/স্ত্রী বা বসের কাছে যখনই কোনো ব্যাপারে ক্ষমা চাইতে যাবেন, নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে কোনো যুক্তি দিবেন না, নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়ে মন থেকে ক্ষমা চান। আজ হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন না, কিন্তু একদিন ঠিকই বুঝতে পারবেন যে এই ভুল বুঝাবুঝির পিছনে আপনার দোষই বেশী ছিলো।
এবার ইউসুফ(আ)-এর পালা ভাইদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার। নিজেকে ইউসুফের জায়গায় কল্পনা করে দেখুন – কেউ যদি আপনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পরিত্যক্ত কোনো কূয়ায় ফেলে দিত আপনি কি তাকে ক্ষমা করতে পারতেন? কেউ যদি প্রায় চল্লিশ বছর আপনার বাবা-মাকে আপনার থেকে আলাদা করে রাখতো আপনি কি তাকে ক্ষমা করতে পারতেন? শেষবার যখন দেখা হয়েছিলো সেইবারও যে আপনাকে ‘চোর’ বলে অপবাদ দিয়েছে আপনি কি তাকে ক্ষমা করতে পারতেন? ইউসুফ(আ) তাঁর ভাইদের শুধু ক্ষমাই করলেন না, তিনি চল্লিশ বছরের সব কষ্টের স্মৃতি এক নিমিষেই ভুলে গেলেন। এটা সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ছিলো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করা। আর তাই ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে তিনি তাঁর ভাইদেরকে পুরোপুরি ক্ষমা করে দিলেন, কারণ আল্লাহ ক্ষমাকারীকে ভালবাসেন।
সে বলল, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু’। (১২:৯২)
ইউসুফ(আ) তাঁর ভাইদেরকে বললেন তাদের বাবা-মাকে মিসরে নিয়ে আসতে। মিসরে প্রবেশের সময় ইউসুফ(আ) তাঁর বাবা-মাকে বিরাট সংবর্ধনা দিলেন। সিংহাসনে বসতে দিয়ে বাবা-মাকে উপযুক্ত সম্মান দিলেন। বলা হয়ে থাকে, ইউসুফের অসামান্য কর্মদক্ষতা ও সততার কারণে এই সময় মিসরে ইউসুফের ক্ষমতা ও মর্যাদা রাজার সমান বা বেশী ছিলো।
আর ইউসুফ তার পিতামাতাকে উচ্চাসনে বসালো আর সে বলল, ‘হে আমার পিতা! এই আমার আগের স্বপ্নের ব্যাখা। আমার প্রতিপালক তা সত্যে পরিণত করেছেন। আর তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন ও শয়তান আমার আর আমার ভাইদের সম্পর্ক নষ্ট করার পরও আপনাদের মরুভূমি থেকে এখানে এনে দিয়ে আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন। আমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন তা সূক্ষ্মভাবে করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞানী, শ্রেষ্ঠ বিচারক। (১২:১০০)
ইউসুফ(আ)-এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের শেখালেন-
ক্ষমা চাওয়ার সাথে সাথে ক্ষমা করে দেয়া
অপরাধটি মনে করিয়ে দিয়ে আর কখনোই কোনো কথা না বলা
‘আমি তোমাকে ক্ষমা করছি’ বললে ক্ষমাপ্রার্থিকে ছোট করা হয়, সেটা না বলে তাকে সম্মান করে এভাবে বলা – ‘আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন’
ক্ষমাপ্রার্থীর দোষকে গোপন করে শয়তানের উপর বা অন্তরের কুমন্ত্রণার উপর দোষ চাপানো
তার এই ভুলের মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে কে শেখাতে চেয়েছেন তা নিয়ে চিন্তা করা।
ইসলামের শিক্ষা কতই না সুন্দর, তাই না!
আরেক গ্রুপের ধারণা – ‘আল্লাহ এক’ বলে স্বীকার করার পর যা ইচ্ছা তা করলেই হয়, ইচ্ছা হলো তো নামাজ পড়লাম ইচ্ছা হলো তো পড়লাম না, সুদ-ঘুষ সহ যে কাজটাকে আমার কাছে সঠিক বলে মনে হবে সেটা করলেই চলবে, কালেমা যখন পড়েছি একদিন না একদিন কোনো এক চিপা দিয়ে তো বেহেশতে যাবই যাব।
এই দুইটি ধারণাই ভুল, কারণ ইসলাম একটি মধ্যপন্থী ধর্ম [১২]। ইসলাম পালন করা মানে এই নয় যে সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে সারাদিন মসজিদে পড়ে থাকতে হবে। আবার ইসলাম মানে এইও নয় যে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ছেড়ে দিয়ে দিন-রাত চাকরী বা ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকলেও ঠিক আছে। ইসলাম মানে হলো:
পড়াশুনা, চাকরি-বাকরি, আচার-ব্যবহার থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য চেষ্টা করা (http://
তবে অবশ্যই ইহকালের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে পরকালের সাফল্যের উপর। আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদত করার আত্মিক চাহিদা (Spiritual need) দিয়ে তৈরী করেছেন। মানুষ যখন এই আত্মিক চাহিদাকে উপেক্ষা করে তখন সে বিভিন্ন পার্থিব বস্তু (যেমন – সম্পদ, টাকা, গান-বাজনা, নতুন নতুন গ্যাজেট, নিত্য নতুন হুজুগ) দিয়ে নিজের সেই চাহিদা পূরণের চেষ্টা করে। সে কখনোই এভাবে সফল হয় না, বরং তার হৃদয়ের ব্যধি আরো বাড়তেই থাকে।